'একটি গাছ একটি প্রাণ' সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ বা নিবন্ধ লেখ || An essay or article about 'A tree is a soul'
তোমাদের সাথে আজকে আমি পরিবেশ বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা একটি গাছ একটি প্রাণ' এই বিষয় নিয়ে একটি প্রবন্ধ তোমাদের কাছে উপস্থাপন করেছি। এরকম পরিবেশ বিষয়ক প্রবন্ধ দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় এসে থেকে তাই অল্প হলেও বিষয়টিকে জেনে রেখো।
একটি গাছ একটি প্রাণ
ভূমিকা: 'মতুর দারুণ দুর্গ থেকে বৃক্ষ দিল মুক্তি।' সর্বসম্মতিক্রমে এ কথা সত্য যে, একমাত্র বৃক্ষই পারে নিঃসাড়, নিস্তত্থ মরুপ্রান্তরের নিষ্ঠুর বেদনাকে দূর করে পৃথিবীতে প্রাণের সবুজ শিহরন দান করতে। কিন্তু সেই পরমবন্ধু বৃক্ষকে পরশুরামের মতো কঠোর কুঠার হাতে নিয়ে উচ্ছেদ করতে উদ্যত হয়ে ধরিত্রীকে বৃক্ষ-শৃদ্ধ মরুভূমিতে পরিণত করতে চলেছি। 'গদা-হাতে মুষল হাতে লন্ডভন্ড করেছে সে সমুদ্র পর্বত।/অগ্নিতে বাষ্পেতে দুঃস্বপ্ন খুলিয়ে তুলেছে আকাশে।' রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-বর্তমানে আমরা সভ্যতার যে প্রবণতা দেখি তাতে বোঝা যায়, সে ক্রমশই প্রকৃতির সহজ নিয়ম পেরিয়ে বহুদূরে চলে যাচ্ছে। মানুষের শক্তি জয়ী হচ্ছে প্রকৃতির শক্তির ওপরে, তাতে লুটের মাল যা জমে উঠল তা প্রভৃত। এই জয়ের ব্যাপারে প্রথম গৌরব পেল মানুষের বুদ্ধিবীর্য, কিন্তু তার পেছন পেছন এল দুর্বাসনা।.. প্রকৃতিকে অতিক্রমণ কিছুদূর পর্যন্ত সয়, তারপরে ফিরে আসে বিনাশের পালা।' কিন্তু বর্তমানে অরণ্য-হনন যে আত্মহননের নামান্তর, তাতে যে একদিন মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে, সেই শুভবোধ আজ মানুষের মনে জাগ্রত হচ্ছে। বৃক্ষরোপণ সেই শুভবোধেরই প্রকাশ।
গাছ ও প্রাণ:
সংস্কৃত শ্লোকে রয়েছে, 'উৎসবে ব্যসনে চৈব, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে/রাজদ্বারে শ্মশানে চ য তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ'। সেই পরমমিত্র বৃক্ষের সলো আমাদের প্রাণের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। অথচ সভ্যতার ক্রমবিকাশের সলো সঙ্গেঙ্গ সবুজ বনানীর স্নেহাঞ্চলের কথা মানুষের মন থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেল। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ নৃশংস ঘাতকের মতো অরণ্য ছেদনে উন্মত্ত হয়ে উঠল। তারা ক্রমশ এই বনজসম্পদকে দুই বাহু মেলে গ্রাস করতে লাগল। কিন্তু বিজ্ঞানের বলে এখন আমরা বুঝেছি যে, অরণ্যসম্পদ মানুষের কত নিকট আত্মীয়, পরম সুহূদ। আজ আমরা উপলব্ধি করছি যে, অরণ্যসম্পদ না থাকলে মাতৃভূমি মরুভূমিতে পরিণত হত। এই অরণ্য আমাদের সবচেয়ে যেটা আগে দরকার সেই প্রাণবায়ু অক্সিজেন দেয়। অরণ্য না-থাকলে কোনোমতেই বৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের বহুল প্রয়োজনীয় বস্তু হল কাঠ, যা আমরা এই বৃক্ষরাজির কাছ থেকে পেয়ে থাকি। অতএব এখন আমাদের একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয় হল বনভূমি রক্ষা করা এবং সাধারণ মানুষকে বৃক্ষরোপণ করতে উৎসাহিত করা।
বনমহোৎসবের সূচনা:
মানবজীবন ও অরণ্যজীবনপ্রাণের এই দুই মহান প্রকাশের মধ্যে বাজে একটিমাত্র ছন্দ। বিজ্ঞাননির্ভর যান্ত্রিক সভ্যতার ক্রমবিস্তার এবং অরণ্য সংহারের মধ্যস্থতায় প্রাকৃতিক আবহাওয়ার যে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে এখন বনসৃজনই তার একমাত্র প্রতিকার। এই বনসৃজনের চরম স্বার্থকতার জন্য বনমহোৎসবের সূচনা, যার উদ্যাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন বৃক্ষরোপণ ব্রতে আমরা যদি-না ব্রতী হতে পারি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিণাম যে কী হবে তা অবর্ণনীয়। সেজন্য তিনি শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসবের সূচনা করেছিলেন এবং সেই সময় থেকে শান্তিনিকেতনের আশ্রমবাসীরা এই বৃক্ষরোপণ উৎসব পালন করে আসছেন। রবীন্দ্রনাথ উপলখি করেছিলেন অরণ্য দিকে দিকে 'মতু বিজয়ের কেতন' উড়িয়ে দিয়ে মানুষকে দিতে পারে অক্ষয় রক্ষাকবচ।
'মধু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ।
ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে হে কোমলপ্রাণ।
বর্তমান ভারতে কবি-প্রবর্তিত বনমহোৎসবের উপযোগিতা স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং তার সার্থক রূপায়ণের জন্য প্রচুর ব্যয়বরাদ্দ ও অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: পরিবেশ বনাম উন্নয়ন – প্রবন্ধ রচনা
বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব:
পৃথিবীর মঙ্গলার্থে, সমগ্র জীবকুলের মঙ্গালার্থে তথা মানবসমাজের মলালার্থে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ-
১. সৃষ্টির আদিলগ্নে গাছ ছিল আমাদের বেড়ে ওঠার ও জীবনধারণের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী।
২ . গাছ আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে-অক্সিজেন জোগান দেয় এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে।
৩. গ্রাহ যে শুধু আমাদের খাদ্য ও অক্সিজেন জোগান দিয়ে বন্ধুর কাজ করে তা নয়; তারা খরা, বন্যা ও ভূমিক্ষয় রোধ করে আবহাওয়ার সমতা রক্ষা করে এবং সর্বতোভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে বন্ধুর কাজ করে।
৪. গাছ প্রকৃতির জলচক্র, কার্বনচক্র, অক্সিজেনচক্র নাইট্রোজেনচক্র প্রভৃতি স্বাভাবিক চক্রগুলিকে সচল ও সক্রিয় রেখে বন্ধুর কাজ করে থাকে।
৫. গাছ অরণ্যভূমি সৃষ্টি করে বলে সেই বনভূমিতে বন্যপ্রাণী বাস করে এবং মাটির ওপর করা পাতা-লতা ও মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ ছড়িয়ে থাকায় মাটির জলধারণের ক্ষমতা বাড়ে। তার ফলে বৃষ্টির সমস্ত জল আর নদীগুলিতে নেমে আসে না, বর্ষায় বন্যা হবার আশঙ্কা দূর হয়।
৬. মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গাছ বা তার অংশ উপাদানরূপে কাজ করে চলেছে। গাছের কাঠে আমাদের বহুমূল্য আসবাব তৈরি হয়। গাছের পাতা মানুষের রোগ সারায়, তাতে বহুমূল্য ঔষধ প্রস্তুত হয়।
৭. গাছের নান্দনিক দিকও আমাদের মনকে প্রফুল্ল করে আমাদের নান্দনিক বোধে উদ্দীপ্ত করে।
৮. গাছ আমাদের প্রাকৃতিক ও স্বতঃস্ফূর্ত হতে সহায়তা করে। আমাদের গাছ শেখায় ন্যূনতম প্রয়োজন সেরে অপরের জন্য নিজেকে ত্যাগ করতে সহনশীল হতে, শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ না-করতে।
সমাজভিত্তিক বনসৃজন:
আধুনিক যন্ত্রসর্বস্ব সভ্যতা পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বহুবিচিত্র চাহিদা পূরণের প্রয়োজনে ডেকে এনেছে যে পরিবেশদূষণের মহামারি, পর্যাপ্তসংখ্যক বৃক্ষরোপণই দিতে পারে তা থেকে নিরাময়ের শ্যামল প্রতিশ্রুতি। বর্তমানে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচার প্রয়োজনে সমাজভিত্তিক বনসৃজনের কর্মসূচি গ্রহণ করে বলা হয়েছে। 'একটি গাছ, একটি প্রাণ'। এই কর্মসূচির সফলতার জন্য চাই আবশ্যিক বৃক্ষরোপণ। আর তার রূপকার গ্রাম-পঞ্চায়েত সমূহ। অরণ্য প্রাণের পরমবন্ধু। কিন্তু কালক্রমে কৃতঘ্ন মানুষ সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের পথে অগ্রসর হয়ে তার সেই পরম হিতৈষী অরণ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে কঠোর হস্তে কুঠার ধারণ করে পরশুরামের মতো পৃথিবীকে বৃক্ষহীন করতে উদ্যত হয়েছে। অরণ্য হননের ফলে যে একদিন জলহীন ছায়াহীন মরুভূমি নেমে আসবে এবং তাতে যে একদিন মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে, সেই শুভবোধ আজ মানুষের মনে জাগ্রত হচ্ছে। সমাজভিত্তিক বনসৃজন ও বন-মহোৎসব সেই শুভবোধের দায়িত্বপূর্ণ প্রকাশ। তাহলে রবীন্দ্রনাথের মতো আমরা বলতে পারব-
আয় আমাদের অলঙ্গনে অতিথি বালক তরুদল-
মানবের স্নেহ সলঙ্গ নে, চল্ আমাদের ঘরে চল।
অরণ্য অঙ্কে ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ:
ভারতীয় সভ্যতা ছিল অরণ্যনির্ভর। জনভূমি ও বনভূমির মধ্যে সেদিন ব্যবধান ছিল না। কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতার নগরকেন্দ্রিকতা অরণ্যকে ধ্বংস করে তার ওপর হাট-কাঠ-পাথরের কৃত্রিম শোভাস্থাপন করে, প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির কবরভূমি রচনা করেছে। আর ভারত অরণ্যজননীর স্নেহাঞ্চল ছায়ায় এক মহান সভ্যতার স্বপ্ন ও সাধনাকে মূর্ত করে তুলেছে। ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের তাই মূলপ্রতিপাদ্য বিষয় হল, উদ্ভিদপ্রাণবন্ত, চেতনাময়। ভারতীয় কবিও প্রার্থনা করে - 'দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর'।
উপসংহার:
শ্যামল সান্ত্বনার বরাভয় হাতে নিয়ে আদিপ্রাণ অরণ্য আজও মানুষকে কাছে ডাকে। অরণ্যবিরল ভারত আজ তাই কাতর প্রার্থনা করছে অরণ্যদেবতার কাছে, পৃথিবীর কাছে-
'মৌনী মাটির মর্মের গান কবে উঠিবে ধ্বনিয়া মর্মরতব রবে
মাধুরী ভরিবে ফুলে ফলে পল্লবে হে মহানপ্রাণ।।'
ভারত আজ অরণ্যসৃজনে মনোনিবেশ করেছে। 'পৃথিবী দিবস' তাকে দিয়েছে নতুন সচেতনতা। সমাজভিত্তিক অরণ্যের অবারিত স্নেহশীতল আশীর্বাদ আজ ভারতের মাথায় ঝরে পড়ুক শতধারায়।