প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা আজকে আমি তোমাদের সাথে বিশিষ্ট সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এর জীবনী রচনা শেয়ার করব। যেটি তোমাদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণে সহায়তা করবে। এই প্রবন্ধ রচনাটি উচ্চমাধ্যমিক ২০১৮ তে এসেছে।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রবন্ধ রচনা
যে কতিপয় কবি-সাহিত্যিক রবীন্দ্রোত্তর যুগে সাহিত্যসাধনে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন, তাঁদের মধ্যে সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম অগ্রগণ্য। নাতিদীর্ঘজীবী এই স্বনামধন্য সাহিত্যিকের জন্ম শতবর্ষ সমাগত। এই পুণ্যলগ্নে বাঙালি পাঠক সমাজের তাঁকে স্মরণ করা একান্ত কর্তব্য।
লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় জন্মেছিলেন বর্তমান ওপার বাংলার দিনাজপুর জেলার বালিয়াডিঙি গ্রামে ১৯১৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি। বাল্যকালে তাঁর পোশাকি নাম ছিল তারকনাথ। কাগজে কলমে এই নাম থাকলেও আমৃত্যু তিনি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তথা 'নারান গাঙুলি' নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন এই সর্বজনপ্রিয় সাহিত্যিক পিতা প্রমথনাথের বদলির চাকুরি সূত্রে তাঁকে শৈশব কৈশোরে স্থানে স্থানে ঘুরে বেড়াতে হয়। ফলে দিনাজপুর, ফরিদপুর, বরিশাল, কলকাতা ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গা জুড়ে তাঁর ছাত্রজীবন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে কৃতী ছাত্র নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় কৃতিত্বের সঙ্গে দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে আই. এ. ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে বিপ্লবী কর্মে জড়িয়ে পড়ার কারণে তাঁকে ১৯৩৫-এ ঐ পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয়নি। পরে বরিশালের ব্রজেমোহন কলেজ থেকে নন কলেজিয়েট ছাত্র হিসাবে ১৯৩৬ সালে আই. এ. পাশ করেন। এরপর ঐ একই কলেজ তেকে ১৯৩৮ সালে ডিস্টিংসনসহ বি. এ. পাশ করেন। ঐখানে পাঠগ্রহণ কালে তিনি সৌভাগ্যবশত অধ্যাপক হিসেবে কবি সাহিত্যিক জীবনানন্দ দাশের সান্নিধ্যলাভ করেন এবং তার দ্বারা প্রভাবিত হন। এরপর যথাসময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলার এম. এ. পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তর্ণ হন এবং কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ ব্রহ্মময়ী স্বর্ণপদক পান। পরবর্তী কালে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এখান থেকে ডি ফিল উপাধি লাভ করেন।
এম. এ. পাশ করার পরপরই তিনি অধ্যাপনা কর্মে নিয়োজিত হন। প্রথমে তিনি জলপাইগুড়িতে আনন্দমোহন কলেজে যোগদান করেন এবং এখানে ১৯৪২-'৪৫ পর্যন্ত প্রায় চার বছর কাল শিক্ষকতা করেন। এরপর কলকাতা সিটি কলেজে ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত দীর্ঘ এগারো বছর অধ্যাপনা করেন। এরপর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু এখানে অধ্যাপনা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এখানে অধ্যাপনা কালীন পরবর্তীতে প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ছাত্র ছিলেন।
ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির সূত্রপাত। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, সাহিত্য সমালোচনা, রম্যরচনা, ছোটখাটো কবিতা, ছোটোদের জন্য শিশু ও কিশোর সাহিত্য ইত্যাদি সবেতেই এই লেখক সমান দক্ষ ছিলেন। তার রচিত উপন্যাসগুলির মধ্যে 'উপনিবেশ'- (তিনখ ৫-১৯৪৪-'৪৭), 'সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী' (১৯৪৪), 'মন্দ্রমুখয়' (১৯৪৫), 'শিলালিপি' (১৯৪৯), 'লালমাটি' (১৯৫১), 'কৃষ্ণপক্ষ' (১৯৫১), 'বৈতালিক' (১৯৫৫), 'অধিসার' (১৯৫৭), 'ভাটিয়ালি', 'পদসঞ্চার', 'অমাবস্যার গান', 'আলোকপর্ণ' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর ছোট গল্পগলির মধ্যে 'বিতংস', 'জন্মান্তর', 'ভাঙাবন্দর', 'দুঃশাসন', 'সাপের মাথার মণি', শ্রেষ্ঠ গল্প', 'স্বনির্বাচিত গল্প' ইত্যাদি উল্লেখের দাবি রাখে। নাটক রচনাতেও তিনি সমান দক্ষ ছিলেন। 'ভীম বধ', 'বাঁচতে চাই', 'আগন্তুক', 'পরের উপকার করিও না' (টেনিদা সিরিজ) ইত্যাদি নাটকগুলি তাঁর প্রমাণ।
সাপ্তাহিক 'দেশ' পত্রিকায় তাঁর রম্য মূলক রচনা 'সুনন্দর জার্নাল' দীর্ঘদিন বাঙালি পাঠককুলকে মজিয়ে রেখেছিল। এছাড়া সাহিত্য সমালোচনামূলক লেখা 'সাহিত্য ছোটগল্প', 'বাংলা গল্প বিচিত্রা', 'ছোটগল্পের সীমারেখা', 'কথাকোবিদ রবীন্দ্রনাথ' ইত্যাদি তাঁর সাহিত্য ও জ্ঞানগরিমা বোধের পরিচয় দেয়। তাছাড়া তিনি চলচ্চিত্রের জন্য কয়েকটি কাহিনি লিখেছিলেন। তিনি টেনিদা সিরিজের জন্য বিখ্যাত। তাঁর বেশ কিছু রচনা অন্য ভাষাতেও অনুদিত রয়েছে।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৬ই নভেম্বর এই বিরল প্রতিভাসম্পন্ন সাহিত্যিক নিতান্ত ৫২ বৎসর বয়সে আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতাতে পরলোকগমণ করেন।
সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর স্বপ্নদৈর্ঘ্য সাহিত্য জীবনে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে 'আনন্দ পুরস্কার' এবং ১৯৬৮ তে 'বসুমতী' সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তবে সাধারণ পাঠককুলের কাছ থেকে সাহিত্যসেবী হিসাবে যে ভালবাসার পুরস্কার তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পেয়েছেন, এমন কি মৃত্যুর এতদিন পরেও স্মরণীয় হয়ে আছেন সেই তুলনায় সেই সব পুরস্কার নিশ্চয়ই তত মূল্যবান নয়।
বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে 'টেনিদা' নামক অমর চরিত্রসৃষ্টির জন্য কিশোর তথা সমগ্র বাঙালি পাঠকের কাছে সব্যসাচী গুণসম্পন্ন এই সাহিত্যিক চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তাতে সন্দেহ নেই।