১২৫তম জন্মবর্ষে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু
ভূমিকা: দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাক্ষাৎ শিষ্য, বিবেকানন্দের জীবনী ও বাণী দ্বারা উদ্বুদ্ধ, যিনি ছিলেন যথার্থ অর্থেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত, যাঁর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পথের দাবি' উপন্যাসের সব্যসাচী চরিত্রের বাস্তব রূপ, পরাধীন ভারতের গ্লানি দূর করার জন্য যে বীর দেশপ্রেমিক আক্ষরিক অর্থেই আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন সেই সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মের সমাগত ১২৫তম বর্ষের প্রাকালে তাঁকে স্মরণ ও তাঁর জীবন সম্পর্কে পর্যালোচনা করা প্রতিটি ভারতবাসীর একান্ত কর্তব্য।
জন্ম ও পরিচয়: ওড়িষ্যার তৎকালীন রাজধানী কটক শহরে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে আনুয়ারি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম হয়। তাঁর পিতা-জানকীনাথ বসু ছিলেন কটক শহরের প্রসিদ্ধ আইনজীবী। মাতা ছিলেন প্রভাবতী দেবী। জানকীনাথের পৈতৃক আদি নিবাস ছিল ২৪ পরগণা জেলার কোদালিয়া গ্রামে।
শিক্ষা: মেধাবী সুভাষচন্দ্রের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কটকের একটি মিশনারি স্কুলে। পরে তিনি ওখানকার র্যাভেনশ' কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন। জন্ম থেকেই সুভাষচন্দ্র ছিলেন দেশপ্রেমিক। এখানে শিক্ষাকালে তাঁর সেই দেশাত্ম্যবোধ তীব্রতর হতে থাকে। এই কলেজের একজন শিক্ষক ওটেন সাহেব একদিন পাঠদান কালে ভারতীয়দের প্রতি কটুক্তি করলে তিনি প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলন সংগঠিত করেন। ফলস্বরূপ তিনি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন এবং এই কলেজ থেকে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে দর্শন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণির অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন। এরপর আই.সি.এস পরীক্ষা দেবার জন্য বিলাত যান এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ স্থান অধিকার করে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ ছাড়াও তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
বিপ্লবী কর্মজীবন: এরপর দেশে ফিরে কোনো সরকারি উচ্চ পদে যোগদান না করে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে দেশের মুক্তি অন্দোলনে যোগ দেন। এই সময় তিনি একে। একে জাতীয় শিক্ষালয়ের অধ্যক্ষ, কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র পদ অলঙ্কৃত করেন। এই সময় তাকে বার বার কারারুদ্ধ করা হয়।
পূর্ণ স্বাধীনতা সমর্থক সুভাষচন্দ্র ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা ও ত্রিপুরীতে নিখিল। ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। এখানে তাঁর চরমপন্থী চিন্তাধারার। সঙ্গে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের তীব্র মতপার্থক্য হলে তিনি কংগ্রেস পরিত্যাগ করে নতুন 'ফরোয়ার্ড ব্লক' দল গঠন করেন এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন পর্বের সন্ধান করতে থাকেন। অন্তর্ধান: ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়। এই সময়ে তিনি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ শাসকদের চোখে ধুলো দিয়ে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত পেরিয়ে বার্লিনে উপস্থিত হন। এখান থেকে কিছুদিন পর সিঙ্গাপুর গিয়ে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তিনি ভারতমুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। এই বাহিনীর নতুন নাম হল 'আজাদ-হিন্দ-ফৌজ'। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৪৫ সালের ১৮ই মার্চ উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্তে একটি অংশ মুক্ত হয় এবং সেখানে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলিত হয়।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জাপান ইংরেজ মিত্র বাহিনীর হাতে পরাজিত হওয়ার ফলে আজাদ-হিন্দ-ফৌজ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সময় সুভাষচন্দ্র নতুন সাহায্যের আশায় জাপানের তাইহোকু বিমানবন্দর থেকে বিমানে মাঞ্জুরিয়া যাত্রা করেন। তারপর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। অনেকে মনে করেন এই ঐ বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তিনি প্রাণ হারান। কিন্তু ভারতবাসী তাঁর এই মৃত্যুতত্ত্বে বিশ্বাস করে না।
উপসংহার: বর্তমান স্বাধীন ভারতে যখন দেশনেতারা পারস্পরিক স্বার্থের হানাহানিতে মত্ত, তাদের আদর্শহীনতা যখন দেশকে যখন সমূহ বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তখন এই নিখাদ দেশপ্রেমিকের জন্মের ১২৫তম বর্ষের প্রাক্কালে তাঁর ত্যাগী জীবন, আদর্শ ও মহত্ত্ব জাতীয় জীবনের দিশারি হোক এই আমাদের অন্তরের কামনা।