নির্বাচিত সাহিত্য সৃষ্ট চরিত্রের জীবনী নির্মাণ প্রফেসর শঙ্কু
বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায় কল্পবিজ্ঞানের কাহিনির অমর স্রষ্টাদের মধ্যে প্লেটো থেকে শুরু করে টমাস মোর, ফ্রান্সিস বেকন, মেরি ও লস্টোনক্রাফ্ট শেলি, জুলে ভার্নে, এইচ. জি. ওয়েল্স, উড ক্যাম্পবেল, অ্যাসিমাভ, রবার্ট হাইনলাইন, ফিলিপ কে ডিক, আর্থার সি ক্লার্ক, রে ব্যাজবেরি, ফ্রাঙ্ক হার্বার্ট, জ্যাক উইলিয়ামসন, ক্যারেল ক্যাপেক, পিটার ফিলিপ্স প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানের সারফেস টেনশন বা পৃষ্ঠটানকে বিষয় করে আচর্য জগদীশচন্দ্র বসু লেখেন তাঁর 'নিরুদ্দেশের কাহিনি' গল্পটি যা 'পলাতক তুফান' নামে অব্যক্ত গ্রন্থে স্থান পায়। গল্পটি হেমেন্দ্রমোহন বোস প্রচলিত কুন্তলীন পুরস্কার অর্জন করে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে জগদানন্দ রায় 'শুক্রভ্রমণ' লেখেন, যেটি তাঁর প্রাকৃতিকী গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে নৃপেন্দ্রকৃয় চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এইচ জি ওয়েলস- এর গল্পের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এর পরবর্তীকালে সুকুমার রায়ের 'হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরিতে', প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'পিঁপড়ে পুরাণ', 'কুহকের দেশে', 'পৃথিবী ছাড়িয়ে', 'ময়দানের দ্বীপ' প্রভৃতি রচনায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের 'অসম্ভবের দেশে', 'অমানুষিক মানুষ', 'মায়াবতীর মায়াকান্না' প্রভৃতিতে কল্পবিজ্ঞানের প্রকাশ লক্ষণীয়। ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, জয়ন্ত বিষু নারলিকার প্রমুখের রচনাতেও কল্পবিজ্ঞানের পরিসর অনেকখানি।
বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান শাখাকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন সত্যজিৎ রায়। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে সন্দেশ পত্রিকায় 'ব্যোমযাত্রীর ডায়রি' প্রকাশের মাধ্যমে কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর বৃহত্তর আত্মপ্রকাশ ঘটে। গল্পের কথক প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। পরবর্তী সময়ে এই বৈজ্ঞানিক-অধ্যাপকের নামের মোড়কে বহু কল্পবিজ্ঞানের গল্প তিনি রচনা করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে- (১) প্রোফেসর শঙ্কু ও হাড় (২) প্রোফেসর শঙ্কু ও ঈজিন্সীয় আতঙ্ক (৩) প্রোফেসর শঙ্কু ও ম্যাকাও (৪) প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল (৫) প্রোফেসর শঙ্কু ও গোলক রহস্য (৬) প্রোফেসর শঙ্কু ও চী-চিং (৭) প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত (৮) প্রোফেসর শঙ্কু ও খোকা (৯) প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু (১০) প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমৎস্য রহস্য (১১) প্রোফেসর শঙ্কু ও কোচাবাম্বার গুহা (১২) প্রোফেসর শঙ্কু ও গোরিলা (১৩) প্রোফেসর শঙ্কু ও বাগদাদের বাক্স (১৪) স্বপ্নদ্বীপ (১৫) আশ্চর্য প্রাণী (১৬) মরুরহস্য (১৭) কর্ভাস (১৮) একশৃঙ্গ অভিযান (১৯) ড. শেরিং-এর স্মরণশক্তি (২০) হিপনোজেন (২১) শঙ্কুর শনির দশা (২২) শঙ্কুর সুবর্ণ সুযোগ (২৩) মনরো দ্বীপের রহস্য (২৪) কম্পু (২৫) মহাকাশের দূত (২৬) নকুড়বাবু ও এল ডোরাডো (২৭) শঙ্কুর কঙ্গো অভিযান (২৮) প্রোফেসর শঙ্কু ও ইউ. এফ, ও (২৯) আশ্চর্জন্ডু (৩০) প্রোফেসর রন্ডির টাইম মেশিন (৩১) শঙ্কু ও আদিম মানুষ (৩২) নেফ্রদেৎ-এর সমাধি (৩৩) শঙ্কুর পরলোক চর্চা (৩৪) শঙ্কু ও ফ্যাঙ্কেনস্টাইন (৩৫) ডা. ড্যানিয়েলির আবিষ্কার (৩৬) ডন ক্রিস্টোবাল্ডির ভবিষ্যদ্বাণী (৩৭) স্বর্ণপর্ণী (৩৮) ইনটেলেকট্রন (অসমাপ্ত) (৩৯) ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা (অসমাপ্ত)।
তাঁর উপরোক্ত রচনাগুলি সন্দেশ ও আনন্দমেলা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে 'প্রোফেসর শঙ্কু', 'প্রোফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা', 'সাবাস প্রোফেসর শঙ্কু', 'মহাসংকটে শঙ্কু', 'স্বয়ং প্রোফেসর শঙ্কু', 'শঙ্কু একাই ১০০', 'পুনশ্চ প্রোফেসর শঙ্কু', 'সেলাম প্রোফেসর শঙ্কু' ইত্যাদি গল্পগুলি রচনাসংগ্রহে স্থান পেয়েছে।
প্রোফেসর শঙ্কুর দ্বিতীয় কাহিনি 'প্রোফেসর শঙ্কু হাড়'-এর ভূমিকা থেকে জানা যায় লেখক বহু পরিশ্রমে এই বিশ্ববরেণ্য বাঙালি গবেষক-বিজ্ঞানীর ঠিকানা খুঁজে বের করেন এবং তাঁর ল্যাবরেটরি থেকে তিনি মোট ৪০টি ডায়েরির সন্ধান পান। পৃথিবীর ২১টি স্থানে তাঁর অভিযানের কাহিনিগুলিই তিনি বিভিন্ন রচনায় লিপিবদ্ধ করেন। প্রোফেসর শঙ্কুর ডায়েরি থেকেই জানা যায় তাঁর জন্ম ১৬ জুন। প্রকৃত নাম ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। ডাকনাম তিলু। তাঁর পিতা ঈশ্বর ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু, পিতামহ ঈশ্বর বটুকেশ্বর শঙ্কু। শকুর পিতামহ ছিলেন গিরিডির তান্ত্রিক সাধু আর পিতা ছিলেন সেই অঞ্চলেরই প্রথিতযশা আয়ুর্বেদ চিকিৎসক। ওই অঞ্চলে তিনি 'ধন্বন্তরি' রূপে পরিচিত ছিলেন। দরিদ্রসেবা, রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসায় তাঁর খ্যাতি ছিল। অকৃতদার প্রোফেসর শঙ্কু পিতার মৃত্যুর পর একাকী জীবন কাটিয়েছেন। বাড়িতে তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে রয়েছে ২৭ বছরের বিশ্বস্ত ভৃত্য প্রহ্লাদ এবং ২৪ বছরের বেড়াল নিউটন।
তাঁর স্থায়ী বসবাসের ঠিকানা বিহারের গিরিডিতে, উত্তী নদীর তীরবর্তী একটি স্থানে। তাঁর শারীরিক বর্ণনা যা পাওয়া যায় তা হল-উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি, গায়ের রং ফরসা, শ্মশ্রুশোভিত মুখমণ্ডল। সতেরো বছর থেকেই মাথায় টাক পড়া শুরু, একুশের মধ্যে মাথাজোড়া টাক পড়ে যায়। কানের দু-পাশে ও ঘাড়ের কাছে কয়েকগোছা পাকা চুল আছে। পোশাকের মধ্যে কোট, প্যান্ট আর গলায় টাই। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।
নির্লোভ প্রকৃতির এই সৎ, আদর্শবাদী, আত্মভোলা মানুষটি কোনোদিনই মানুষের জাতধর্মকে বড়ো করে দেখেননি। অত্যাচারীর আস্ফালন সহ্য করেননি। বুদ্ধির স্থিরতা, চরিত্রের সংযম, নির্ভীকতা তাঁর চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর প্রাচীন সাহিত্য, শিক্ষা ও কিংবদন্তির প্রতি তিনি অপার শ্রদ্ধাশীল। এ ছাড়াও ভূত-প্রেত, তন্ত্রমন্ত্র, টেলিপ্যাথি, ক্লেয়ার জয়েসে তাঁর অগাধ বিশ্বাস। নিয়মিত ব্যায়ামচর্চা করে শরীরকে তাজা রেখেছেন। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠাকে তিনি অভ্যাসে পরিণত করেছেন। নদীর ধারে প্রাতভ্রমণকে তিনি নিত্য কৃত্যের মধ্যে ঠাঁই দিয়েছেন। গিরিডির স্কুল থেকে ১২ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৪ বছর বয়সে কলকাতার কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। ১৬ বছর বয়সে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রিতে ডবল অনার্স নিয়ে বিএসসি পাস করেন। জীবনে কোনোদিন কোনো পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় হননি। কুড়ি বছর বয়স থেকে কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। আবিষ্কারক হিসেবেই তাঁর মূল পরিচিতি। জীবনে ৭০টির বেশি জিনিস তিনি আবিষ্কার করেছেন। আবিষ্কারক হিসেবে তাঁর আদর্শ ইহুদি বিজ্ঞানী স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন। প্রোফেসর শঙ্কুর বিখ্যাত আবিষ্কারগুলির মধ্যে রয়েছে লুপ্ত স্মৃতি ফেরানোর জন্য রিমেমব্রেন, সস্তায় আলো পাওয়ার জন্য লুমিনিম্যাক্স, সর্বরোগহর বড়ি মিরাকিউরল, বিশেষ নিশ্চিহ্ননান্ত অ্যানাইহিলিন, শীত-গ্রীষ্মে শরীরে তাপ নিয়ন্ত্রণের ট্যাবলেট এয়ারকন্ডিশনিং পিল, ঘুমের ওষুধ সমনোলিন, অচেনা ভাষা ইংরাজিতে অনুবাদের জন্য লিঙ্গুয়াগ্রাফ, হাফ গান বা নস্যাস্ত্র, মঙ্গলে পাড়ি দেওয়ার রকেট, বাইকর্নিক, অ্যাসিড ও পারাডক্সাইট পাউডার, রোবট বিধুশেখর, ফিস পিল, ট্যান্টাম বোরোপ্যাক্সিনেট একুইয়স ভেলোসিলিকা, বটিকা ইন্ডিকা, পেট্রোম্যাক্স, আমলা গাছ, জীবন্ত প্রাণীর কঙ্কাল দেখার চশমা, এসেন্স, সংকর ফুল, কার্বোধীনের পাতলা জামা, মাইক্রোসোনোগ্রাফ, কার্বোতায়াবলিক অ্যাসিড, ইলেকট্রিক পিস্তল, নিওস্পেকট্রোস্কোপ, নার্ভাইটা বড়ি, তৃয়ানাশক বড়ি, টি-পিল, শ্যাঙ্কলন, সেরিব্রিলান্ট প্রভৃতি। তাঁর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলির জন্য তিনি সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বৈজ্ঞানিকের সম্মান লাভ করেন। ব্রেজিলের রাটানটান ইনস্টিটিউট থেকে ডক্টরেট উপাধি পান। আবিষ্কারক হিসেবে টমাস আলভা এডিসনের পরই প্রোফেসর শঙ্কুর নাম পাঁচটি মহাদেশেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃত। মূলত পদার্থবিদ্যার মানুষ হলেও সাহিত্য, গণিত, প্রত্নতত্ত্ব, জীববিদ্যা, ভূতত্ত্ব, মনস্তত্ব, অপরাধবিজ্ঞান, জীবরসায়ন, নৃতত্ত্ব, ইলেকট্রনিক্স, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি শাস্ত্রে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য রয়েছে। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বিচরণ প্রিয় এই বৈজ্ঞানিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, জার্মানি, জাপান, স্পেন, মিশর, নরওয়ে, সুইডেন ভ্রমণের পাশাপাশি কখনো সাহারার মরুভূমিতে, আবার কখনও-বা আফ্রিকার জঙ্গলে যেমন ঘুরে বেড়িয়েছেন তেমনই কখনও পৌঁছে গেছেন মঙ্গলগ্রহে কিংবা সমুদ্রের মাঝে কোনো অজানা দ্বীপে। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে বিশিষ্টদের তালিকায় রয়েছেন। ইংল্যান্ডের জেরেমি সন্ডার্স এবং জার্মানির ইহলহেলম ক্রোল। এই দুজন নানান অভিযানে শঙ্কুর সঙ্গী হয়েছেন। এ ছাড়াও ইংল্যান্ডের সামারভিল এবং জাপানের হিদেচি সুমার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ও অভিযানের কথা জানা যায়। এ ছাড়াও গিরিডি নিবাসী অবিনাশচন্দ্র মজুমদার এবং মাকড়দহের শ্রী নকুড়চন্দ্র বিশ্বাস প্রোফেসর শঙ্কুর কয়েকটি অভিযানে সঙ্গী হিসেবে থেকে তাঁকে নানান বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। দেশবিদেশের এইসব অভিযানেরই রোমহর্ষক বর্ণনা তিনি তাঁর ডায়ারির পাতায় লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রসঙ্গত উঠে এসেছে তাঁর প্রতি সুইটজারল্যান্ডের বিজ্ঞানী কর্নেলিয়াস হামবোল্ট ও ইতালির বিজ্ঞানী কাউন্ট লুইজি রন্ডির শত্রুতার কথা, তাঁর গোয়েন্দাগিরির নানান অ্যাখ্যান, জীবনের নানা অসাফল্য বা ব্যর্থতার বিবরণ। প্রোফেসর শঙ্কুর শেষ ডায়ারিটি হল ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা (অসমাপ্ত), যেটি ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-য় প্রকাশিত হয়।