শতবর্ষে সত্যজিৎ রায়
ভূমিকা: একমাত্র কবিতা ছাড়া সাহিত্যের সব শাখায় যিনি অবাধে বিচরণ করেছেন, চিত্রকলা সঙ্গীত ও সর্বোপরি আধুনিক এক চিত্রভাষা-বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প যাঁর হাত ধরে আধুনিকতার উত্তরণে চরম বিকশিত হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের পরেই যাঁর প্রতিভা সার্থকতা খুঁজে ফিরেছে অজস্র চরিতার্থতায়, ধাবিত হয়েছে নানা দিগন্তের লক্ষ্যে এবং কবি সার্বভৌমের পরেই যিনি বাঙালিদের মধ্যে অবিসংবাদিত রূপে উজ্জ্বলতম ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, বিংশ শতাব্দীর সেই বিস্ময়কর শিল্পী সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবর্ষের প্রাক্কালে তাঁকে ফিরে দেখা প্রতিটি সংস্কৃতিমনস্ক নাগরিকের একান্ত কর্তব্য।
জন্ম, পারিবারিক পরিচয় ও শিক্ষা: ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২রা মে কলকাতার ১০০নং গড়পার রোডে সত্যজিতের জন্ম হয়। পিতা-অনবদ্য 'আবোল তাবোল' রচয়িতা সুকুমার রায়। মাতা-সুপ্রভা দেবী। পিতামহ ছিলেন স্বনামধন্য শিশু সাহিত্যিক, ভারতে আধুনিক মুদ্রণ শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী। মাত্র ৩২ বছর বয়সে সত্যজিতের পিতার অকাল মৃত্যু হলে তাঁর মা তাঁকে নিয়ে বকুলবাগানে তাঁর মামার কাছে চলে আসেন। এরপর বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে যথাসময়ে ম্যাট্রিকুলেশান পাস করে পিতা ও পিতামহের মত প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ছাত্রজীবনে স্কুল ও কলেজে পড়াকালীন তাঁর মধ্যে সঙ্গীত পিপাসা জেগে ওঠে। তিনি ক্রমে ব্রহ্মসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত, ভারতীয় মার্গ-সঙ্গীত ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এ ছাড়া ফিল্ম দেখে, কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়ে, সঙ্গীতচর্চা করে তাঁর কলেজ জীবন কাটে। এই ভাবে ১৯৩৯ সালে এখান থেকে তিনি বি এ পাশ করেন। পরের বছর শিল্প শিক্ষার জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। এখানে শিক্ষাগ্রহণকালীন দুই নমস্য শিল্পশিক্ষাগুরু নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে আসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্থোপার্জনের তাগিদে এই শিল্পশিক্ষা অসমাপ্ত রেখে ১৯৪২ সালে কলকাতা চলে আসেন।
কর্মজীবন: এরপর ১৯৪৩-এ মাত্র আশি টাকা মাসিক বেতনে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন কোম্পানি ডি.জে.কিমার-এ জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার পদে এই বিশাল শিল্পস্রষ্টার কর্মজীবন শুরু হয়। কর্মদক্ষতার গুণে তিনি কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি এই প্রতিষ্ঠানের আর্ট ডাইরেক্টারের পদে উন্নীত হন। ইতোমধ্যে ১৯৫৫ সালে তাঁর পরিচালনায় 'পথের পাঁচালি' চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করে। এই সাফল্যের পর তিনি পুরোপুরি চিত্রপরিচালকের জীবন বেছে নেন এবং ১৯৫৬ তে চাকুরিতে ইস্তফা দেন।
এরপরের ইতিহাস শুধু সাফল্যের ইতিহাস। সিনেমা শিল্পের এই ভয়ঙ্কর প্রতিভাধর পুরুষটি প্রায় ৩৫ বছর ধরে একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং এবং ক্রমে সাফল্য ও খ্যাতির চূড়ায় উঠেছেন। চিত্র পরিচালনার জীবনে ছোট বড় পূর্ণদৈর্ঘ্য ও সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্র মিলিয়ে তিনি ছত্রিশটি (২৮টি কাহিনি চিত্র, ৫টি তথ্যচিত্র ও ৩টি দূরদর্শন চিত্র) চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। যদিও তাঁর সৃষ্ট প্রথম চলচ্চিত্র 'পথের পাঁচালি' তাঁকে সব চাইতে খ্যাতিমান করেছে, তবুও তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাহিনি চিত্রগুলি হল-'অপরাজিত' (১৯৫৬), 'পরশপাথর' ও 'জলসাঘর' ('৫৮), 'অপুর সংসার' ('৫৯), 'দেবী' ('৬০), 'তিনকন্যা' ('৬১), 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' ('৬২), 'অভিযান' ('৬২), 'মহানগর' ('৬৩), 'চারুলতা' ('৬৪), 'কাপুরুষ' ও 'মহাপুরুষ' ('৬৫), 'নায়ক' ('৬৬), 'চিড়িয়াখানা' ('৬৭), 'গুপী গায়েন ও বাঘা বাইন' ('৬৯), 'অরণ্যের দিনরাত্রি' ('৭০), 'প্রতিদ্বন্দ্বী' ('৭০), 'সীমাবদ্ধ' ('৭১), 'অশনি সংকেত' ('৭৩), 'সোনার কেল্লা' ('৭৪), 'জন অরণ্য' ('৭৫), 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ি' ('৭৭), 'জয় বাবা ফেলুনাথ' ('৭৮), 'হীরক রাজার দেশে' (৮০), 'ঘরে বাইরে' (৮৪), 'গণশত্রু' (৮৯), 'শাখা প্রশাখা' ('৯০), 'আগন্তুক' ('৯১) ইত্যাদি। কবিতা গল্প নাটক ও গানের মত চলচ্চিত্রের যে আলাদা আঙ্গিক বিস্তার ও ভাষা আছে, তা তিনিই প্রথম তুলে ধরেন। চলচ্চিত্র নির্মাণে এখানেই তাঁর বিশিষ্টতা।
সাহিত্যকর্ম: চলচ্চিত্র নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজের মাঝে তিনি বেশ কিছু সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর ও পিতা সুকুমার রায়ের সম্পাদিত 'সন্দেশ' পত্রিকাটি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে পুনঃপ্রকাশ করেন। সম্পাদনা ও অলঙ্করণের পাশাপাশি এই পত্রিকায় পৃথকভাবে অনেকগুলি কিশোরপাঠ্য উপন্যাস ও গোয়েন্দা কাহিনি লেখেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলি হল- 'বাদশাহি আংটি', 'এক ডজন গল্প', প্রফেসার শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা' (১৯৭০), 'গ্যাংটকে গন্ডগোল', 'সোনার কেল্লা' ('৭১), বাক্স রহস্য' ('৭৩), 'কৈলাসে কেলেঙ্কারি' ('৭৪), 'সাবাশ প্রফেসার শত্রু', 'রয়েল বেঙ্গল রহস্য' ('৭৪), 'বিষয় চলচ্চিত্র', 'আরও এক ডজন', 'জয় বাবা ফেলুনাথ' ('৭৬) ইত্যাদি। এইসব কাহিনির মধ্যে তাঁর সৃষ্ট 'ফেলুদা' 'তোপসে', 'জটায়ু' 'প্রফেসার শঙ্কু' চরিত্রগুলি সকল পাঠকের কাছে অমর হয়ে আছে। সব মিলিয়ে আমরা তাঁর কাছ থেকে মোট ৬০ খানি বই পেয়েছি। তিনি যদি শুধুমাত্র সাহিত্য কর্ম নিয়েই থাকতেন তাহলেও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নাম অক্ষয় ও অমর হয়ে থাকত।
অন্যান্য কর্ম: চলচ্চিত্র পরিচালনা ও সাহিত্যকর্ম ছাড়াও এই মহান স্রষ্টা 'তিন কন্যা' চলচ্চিত্র থেকেই সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেন। তাঁর সৃষ্ট পোস্টার শিল্প এক নিখুঁত দর্শনীয় বস্তু। এ ছাড়া বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কন এবং টাইপোগ্রাফিতে তিনি নতুন চিন্তা ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ জীবনানন্দের 'রূপসী বাংলা' বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কন ও 'রে-রোমান' টাইপ প্রবর্তন উল্লেখযোগ্য।
পুরস্কার প্রাপ্তি: বিভিন্নমুখী শিল্পকর্মের জন্য তিনি সারা জীবনে অনেকগুলি পুরস্কারে সম্মানিত হন। ছাত্রাবস্থায় ১৯৩৬-এ 'বয়েজ ওন পেপার' পত্রিকার ছবি তোলার জন্য পুরস্কার প্রাপ্তি দিয়ে এই অভিযাত্রা ঘটে। এরপর 'পদ্মশ্রী' ('৫৮), 'পদ্মভূষণ' ('৬৫), 'আকাদেমি পুরস্কার' ও 'ম্যাগসেসাই পুরস্কার' ('৬৭), 'স্টার অব যুগোশ্লাভিয়া' ('৭১), 'গোল্ডেন হুগো' ('৭৩), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট ও বিশ্বভারতীর 'দেশিকোত্তম', 'হেডলেস এঞ্জেল ট্রফি' ও 'ভিসকান্তি' (৮২), ফরাসী সরকার প্রদত্ত 'লিজিয়ন অব অনার' (৮৭), 'অরসন ওয়ালেম পুরস্কার' ('৮৯), নিউইয়র্কের 'একাডেমি পুরস্কার' ('৯২), এবং সে বছরই ভারত সরকার কর্তৃক 'ভারতরত্ন' পুরস্কারে সম্মানিত হন। এ ছাড়া সারা জীবনে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারকের আসন অলংকৃত করেছেন।
মৃত্যু: ১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল এই মহান স্রষ্টার মহাপ্রয়াণ ঘটে।
উপসংহার: সাহিত্য, চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত, সর্বোপরি চলচ্চিত্র শিল্পের নতুন পথের দিশারি, সংস্কৃতি জগতের এই বহুধা বিস্তৃত বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী, সত্যিকারের অর্থে রবীন্দ্রনাথের পরে শেষ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি ও 'ভারতরত্ন' সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবর্ষের প্রাক্কালে তাকে আমরা শতকোটি প্রণাম জানাই।