আজকে আমি তোমাদের সাথে শেয়ার করতে চলছি দ্বাদশ শ্রেণীর বাংলা বিষয় এর প্রকল্পের গ্রন্থ সমালোচনা টপিকটি। এখানে মিশর রহস্য উপন্যাসটির গ্রন্থ সমালোচনা করে নিন্মরূপ আলোচনা করা হয়েছে। তোমাদের যদি এই উপন্যাসটির গ্রন্থ সমালোচনা প্রয়োজন হয়ে থাকে তবে অবশ্যই এখান থেকে সংগ্রহ করে তোমরা তোমাদের জন্য ব্যবহার করতে পারো। অতএব, আর বেশি দেরি না করে গ্রন্থ সমালোচনাটি সংগ্রহ করে নাও।
প্রথম পাতা
ভূমিকা : সাহিত্যিক, কবি, প্রাবন্ধিক প্রত্যেকেই তাঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে পৃথক সাহিত্যসংরূপকে মাথায় রেখে রচনা করেন। লেখকের ‘আপন মনের মাধুরী’ মিশিয়ে রচিত সাহিত্যকর্ম যখন অগণিত পাঠকের হাতে এসে পৌঁছোয়, তখন পাঠক তার রস আস্বাদন করে নিজস্ব আর্থসামাজিক অবস্থান থেকে। বয়স, অর্থনৈতিক কাঠামো, দেশকালের প্রেক্ষিতে সর্বোপরি সময়ের তারতম্যে বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন সময়ে মানুষকে নতুন করে ভাবিয়েছে। একটি গ্রন্থের একেবারে প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে শেষ মলাট পর্যন্ত সাহিত্যকর্মটির সঙ্গে যুক্ত। লেখকের রচনার সময় নতুন করে পরবর্তী সংস্করণে কিছু সংযোজন বা বিয়োজন অনেক ক্ষেত্রেই পৃথক অর্থ বহন করে থাকে। লেখকের রচনার পর পাঠকের হাতে পৌঁছে যাওয়ারও পর কোনো চিন্তাশীল পাঠক যদি লেখকের রচনার প্রতি ব্যক্তিগত ভালোলাগা-খারাপ লাগাকে দূরে সরিয়ে রেখে যুক্তিমনস্ক হয়ে গ্রন্থটির একটি বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করেন, যা অবশ্যই পাঠকের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করাবে এবং সুস্থ বিতর্কের পরিবেশ সৃষ্টি করলেও কোনো সময়েই কোনো ব্যক্তি বা সৃষ্টিকে আলাদা করে আক্রমণ করবে না – তবে তা একটি সার্থক গ্রন্থ সমালোচনারূপে গণ্য হবে।
উদ্দেশ্য : মানবসমাজের চিরকালের বন্ধু গ্রন্থ। যখন মানুষের কাছে আধুনিক যুগের বিনোদনের মতো বহুবিধ মাধ্যম ছিল না, তখন গ্ৰন্থই মানব সমাজের জ্ঞান আহরণের, অবসর বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল, কিন্তু ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত উন্নয়নে গ্রন্থ তার পূর্বেকার মর্যাদা হারাচ্ছে। কেউ আর আগের মতো নতুন গ্রন্থপ্রকাশের অপেক্ষায় দিন গোনে না। গ্রন্থ সমালোচনা পড়ে যদি আগ্রহ বোধ করে তবেই পাঠক গ্রন্থমুখী হয়। তাই সংক্ষেপে গ্রন্থের ভালো মন্দ জানিয়ে নির্দিষ্ট গ্রন্থটির প্রতি পাঠককে আগ্রহী করে তোলাই গ্রন্থ সমালোচনার মূল উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয় পাতা
উপন্যাস – মিশর রহস্য (সন্তু কাকাবাবু সিরিজ)
লেখক – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (নীললোহিত)
শ্রেণি – রহস্যময় গোয়েন্দা উপন্যাস।
প্রথম প্রকাশ – ১৯৮৪ খ্রি: (আনন্দমেলা পত্রিকা)
বর্তমান প্রকাশক – আনন্দ পাবলিশার্স
তৃতীয় পাতা
সন্তু-কাকাবাবু জুটি বাঙালির খুব প্রিয়, অত্যন্ত কাছের মানুষ। সাহসী, দৃঢ়, তথাকথিত বাঙালির কাছে নায়কোচিত মর্যাদায় ভূষিত কাকাবাবু ওরফে রাজা রায়চৌধুরী আর তার ভ্রাতুষ্পুত্র সন্তু।
কাকাবাবু আর সন্তুর অ্যাডভেঞ্চার কিশোর থেকে বৃদ্ধ অনেকেরই চিরকালের চেনা। একের পর এক অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রোমাঞ আর ভ্রমণকাহিনির স্বাদ দুই-ই দিয়েছে। কাকাবাবু-সন্তু ভারতের বাইরে যেসব জায়গায় অভিযানে গিয়েছেন তার মধ্যে মিশর অন্যতম। কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে মিশর। ঘটনার ঘনঘটা, চরিত্রের ঘাতপ্রতিঘাত আর টানটান রহস্য। প্রথম থেকে এই উপন্যাসে সন্তু একা। মিশর-পিরামিড-ফারাও- মমি-হায়রোগ্লিফিক লিপি এগুলোর সম্পর্কে আমাদের চিরকালীন – কৌতূহলও যথেষ্ট। মিশরীয়দের মৃত্যুর পরেও অন্য জীবনের অস্তিত্বের কথা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের জানার তাগিদ জুগিয়েছে। এসবের
মিশ্রণেই ‘মিশর রহস্য’ এক যথার্থ সাহিত্যনির্মাণ। গল্পের প্রথমদিকে একা একা সন্তুর তিলজলা এলাকায় পুকুরে নিখোঁজ দুটি ছেলেকে খুঁজতে যাওয়ার ঘটনার কাহিনির সঙ্গে সেই অর্থে কোনো যোগ নেই। একা একা সন্তু কেনই বা এরকম একটি জায়গায় চলে গেল, তা তার অন্য গল্পে পড়া চরিত্রের সঙ্গে খানিক বেমানান। ‘সন্তু ও একটুকরো চান’ বা ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন’ প্রভৃতিতে আমরা সত্ত্বকে নিজেই রহস্যভেদে অনেকটা ভূমিকা নিতে দেখেছি। কিন্তু আলোচা উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমরা সত্ত্বকে একেবারেই ছেলেমানুষি করতে দেখি। বইটির প্রচ্ছদ এবং মাঝেমাঝে কিছু অলংকরণ বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। প্রচ্ছদে ‘মিশর রহস্যে’র সঙ্গে খয়েরি রঙের ব্যবহার কোথাও গিয়ে মিশর এবং রহস্যকে একসঙ্গে সমন্বিত করেছে। গল্পের শুরুতে আল মামুনের কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসা, কাকাবাবুর হঠাৎ দিল্লি চলে যাওয়া—রহস্য ঘনীভূত হওয়ার সম্ভাবনা প্রথম থেকেই দেখা যাচ্ছিল। দিল্লিতে গেস্ট হাউসে কাকাবাবুর গুলি লাগার ঘটনা কাহিনিতে নতুন মোড় আনে। তবে এই গুলি লাগার ঘটনা আর কাকাবাবুর হঠাৎ করে “Bloody fool look behind” বলার মধ্যে অনেকটা অতিনাটকীয়তা দেখা গেছে।
কাকাবাবুর অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ততা, প্রখর জ্ঞান আর অগাধ সাহস। আল মামুনের দেখিয়ে যাওয়া ছবির সাংকেতিক অর্থ তিনি তার কাছে প্রকাশ করেননি। বাঙালিকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন — “ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন / চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।” এই উপন্যাসেও সেই প্রসঙ্গ এসেছে। ঘরকুনো, ‘মুখে বিশ্বজয়’ করব ভাবধারী বাঙালির কাছে কাকাবাবু যথার্থই একটা ভিন্নধারার প্রতিনিধি। কাকাবাবু মিশর যাওয়ার পর আচমকাই অপহূত হন হানি আলকাদি নামে মুফতি মহম্মদের অন্য এক শিষ্যের কাছে। এই হানি আলকাদি চরিত্রটির নির্মাণ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক অদ্ভুত টানাপোড়েনে। সুদর্শন, যার সম্পর্কে অনেক আতঙ্ক সেই হানি আলকাদি সংস্কৃতিমনস্ক, মিশরের গুহাতে বসেও রবীন্দ্রসাহিত্য পড়েন। কাকাবাবুর অ্যাডড্যোরে আমরা সেই অর্থে রহস্যের গন্ধ যা পাই, অনেকক্ষেত্রেই তা পূর্ব বিবৃত থাকে। অর্থাৎ মূল খোঁজ কোন বিষয়ে সেটা পাঠক অনেকক্ষেত্রেই জানতে পারে। আলোচ্য ক্ষেত্রে মুফতি মহম্মদের দিল্লিতে বসে আঁকা ছবি আর কাকাবাবুরও ছবি এঁকে প্রত্যুত্তর দেওয়া প্রথম থেকেই রহস্যের একটা দিককে উন্মোচিত করে দিয়েছে। হায়রোগ্লিফিক লিপি জানা লোক সেই অর্থে খুব কমই রয়েছে, তা গল্পে আমরা বুঝতে পারছি। মুফতি মহম্মদের নিকটতম লোকজনরাও সে ভাষা আয়ত্ত করতে পারেনি। কলকাতা শহরে থাকলেও কাকাবাবুর চরিত্রনির্মাণে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই শক্তিশালী এবং মননশীল মেধার দিকটি বজায় রেখেছেন, যার ফলে তিনি একমাত্র সেই সাংকেতিক ছবির রহস্যভেদ করতে পারেন।
সমগ্র উপন্যাসে চরিত্রগুলির বিভিন্নরকম বিন্যাস আমরা দেখতে পাই। যে আল মামুন কাকাবাবুর কাছে প্রথম এসেছিলেন সাহায্য চাইতে, তিনি গল্পের শেষে গিয়ে খলনায়করূপে অবতীর্ণ হন। হানি আলকাদির সঙ্গে কাকাবাবুর সম্পর্ক বেশ ভালো আর তাকে প্রথম থেকে যেরকম দেখানো হয়েছিল, পরবর্তীকালে তার চরিত্রের এক বড়ো ধরনের বিবর্তন ঘটায় যথেষ্ট আগ্রহের স্যার ঘটেছে পাঠকের মনে।
গল্প বলার কৌশল, রহস্যের ঘনঘটা আর মিশরের অনুষঙ্গে কাহিনির আবর্তন—সবমিলিয়ে ‘মিশর রহস্য’ কাকাবাবু সিরিজের একেবারে প্রথম সারিতেই থাকবে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ক্রান্তদর্শী লেখক যিনি একাধারে ‘প্রথম আলো’, ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’-এর মতো যুগান্তকারী উপন্যাস রচনা করেন; তিনিই আবার কিশোর এবং সববয়সের কথা মাথায় রেখে যখন কাকাবাবু-সন্তু চরিত্রগুলিকে সাজান, তাতেও যথেষ্ট অনন্যতা রাখেন। এই ‘মিশর রহস্য’-এ সন্তুদের পাড়ার বিমানদাকে আমরা বেশ কিছুটা অংশে দেখতে পাই। নরেন্দ্র ভার্মাও আছেন। কাকাবাবুর গল্পে জোজো, রগুন, দেবলীনা প্রভৃতি চরিত্রগুলি পার্শ্বচরিত্র হয়ে অনেকসময়ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আলোচ্য ক্ষেত্রেও বিমান অনেকটা সেরকম ভূমিকা পালন করেছে। ‘মিশর রহস্য’ কাকাবাবুর চরিত্রকে আরও তীক্ষ্ণ, শানিত আর দৃঢ় করে তুলেছে। যা পরবর্তী সময়ে তার অন্যান্য অনেক রহস্যের থেকে অভিনব। কাকাবাবু আর অ্যাডভেঞ্চারে যাবেন না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তবু তার সৃষ্টি হয়তো কোনো গ্রীষ্মের ছুটির দুপুরে কম্পিউটার গেমসে ব্যস্ত স্কুলপড়ুয়া কিশোর-কিশোরীকে আবার বইমুখো করবে। ফারাও- স্ফিংস-পিরামিড-মমির জমাট রহস্যে সে মনে মনে মিশরে পাড়ি দেবে- এখানেই সাহিত্যিকের জয়।