নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য সৃষ্ট চরিত্র টেনিদার জীবনী নির্মাণ | class 12 bengali project tenida

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য সৃষ্ট চরিত্র টেনিদার জীবনী নির্মাণ | class 12 bengali project tenida
Photo of author

Published On:

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য সৃষ্ট চরিত্র টেনিদার জীবনী নির্মাণ

‘ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস। ইয়াক্, ইয়াক্।’—চিরপরিচিত এই সোল্লাস চিৎকারের সঙ্গে পরিচিত নয় এমন বাঙালি পাঠক-পাঠিকা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রেমেন্দ্র মিত্রের যেমন ঘনাদা, শিবরাম চক্রবর্তীর যেমন হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন, তেমনই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় চরিত্র।

১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ‘অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির’ থেকে টেনিদা সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘চার মূর্তি’ প্রকাশিত হয়। তার আগে ‘শিশুসাথী’-তে এই উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত। মূলত শিশুদের খুশি করার উদ্দেশ্য নিয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যে চরিত্রের জন্ম দিয়েছিলেন, তা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজও সববয়সি পাঠক-পাঠিকাকে নির্মল আনন্দ প্রদান করে চলেছে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয় ‘চার মূর্তির অভিযান’ উপন্যাসটি। পাঁচটি উপন্যাস, তেত্রিশটি গল্প এবং একটি কৌতুক নাটিকায় টেনিদা-সহ হাবুল, ক্যাবলা এবং প্যালারামের নানান মজার ঘটনার পরিচয় পাওয়া যায়। গল্পগুলির অধিকাংশই কলকাতা এবং তার শহরতলিকেন্দ্রিক। তবে চার মূর্তির হাজারিবাগ, ডুয়ার্স এবং দার্জিলিং অভিযানও বিখ্যাত। টেনিদা সিরিজের গল্পগুলির মূলত দুটি ধরন লক্ষ করা যায়—কোনো কোনো গল্পে টেনিদা নিজেই নিজের তথাকথিত বীরত্বের কাহিনি অতিরঞ্জিত করে শোনাচ্ছে। আর বাকি ক্ষেত্রে টেনিদা আর প্যালা অথবা চার মূর্তির মিলিতভাবে কোনো মজাদার অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, যেখানে নানান হাস্যকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অবশেষে কোনো রহস্যের উদ্ঘাটন হয়েছে। লেখক প্রতিটি লেখা প্যালারামের জবানিতে লিখেছেন এবং প্যালারাম যে স্বয়ং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নিজে, তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। কারণ তিনি প্যালারামের কথা লিখেছেন উত্তম পুরুষে।

আরও পড়ুন : মিশর রহস্য গ্রন্থ সমালোচনা প্রকল্প

রচনা অনুসারে কলকাতার পটলডাঙা স্ট্রিটের বাসিন্দা টেনিদার আসল নাম ভজহরি মুখোপাধ্যায়। তার ডাকনাম আসলে টেনি। চার মূর্তির বাকি তিন সদস্য ক্যাবলা, হাবুল আর প্যালারামের থেকে সে বয়সে বড়ো। তার উপস্থিত বুদ্ধি, সাহস এবং সততার জন্য বাকিদের কাছে সে ‘হিরো’। আর তাই তার ‘টেনি’ নামের সঙ্গে বিজয়ীর মুকুটের পালকের মতো জুড়ে গেছে ‘দা’ সম্বোধনটি যা ‘দাদা’র সংক্ষিপ্তরূপ। গল্পে টেনিদার বয়স কুড়ি পঁচিশ। পুরো ছয় হাত লম্বা, বিয়াল্লিশ ইঞ্চি চওড়া বুক, ভাঁটার মতো চোখ, খাঁড়ার মতো নাক, রণডম্বরুর মতো গলা, খটখটে জোয়ান-ইত্যাদি নানান বিশেষণে মুড়ে টেনিদাকে লেখক বর্ণনা করেছেন। বিশেষ করে টেনিদার নাক, যাকে কখনও মৈনাক পর্বত, কখনও পিরামিড, কুতুবমিনার এমনকি গন্ডারের খাঁড়ার সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে। রণডম্বরুর মতো গলায় টেনিদার সংগীতচর্চা প্রসঙ্গে লেখক লিখেছেন – “…..একবার টেনিদা নাকি অ্যায়সা কীর্তন ধরেছিল যে তার প্রথম কলি শুনেই চাটুজ্যেদের পোষা কোকিলটা হার্টফেল করে।”

এটিও পড়ুন :  Class 12 / English Project \ Changing the Background/Time/Social Context of a Play.

গল্প-উপন্যাস থেকে টেনিদার বাড়ির লোকজনের কথা বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে সে যে বনেদি ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, তা জানা যায়। টেনিদার অ্যাডভেঞ্চার তার তিন সাগরেদকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। তারা হল—হাবুল অর্থাৎ স্বর্ণেন্দু সেন, যার বিখ্যাত ঢাকাই উচ্চারণ হাসির পরিস্থিতিকে আরও হাস্যকর করে তোলে। মনে হয়, খাস কলকাত্তাইয়া আবহাওয়ায় এক কাঠবাঙালকে এনে লেখক আসলে ভাষায় একটু বৈচিত্র্য আনতে চেয়েছেন। হাবুল বক্সিং জানে। কমলেশ ব্যানার্জি হল প্যালারাম। প্যালা জ্বরের রুগি, প্যালা পটল দিয়ে সিংগি মাছের ঝোল আর বাসক পাতার রস খায় বলে টেনিদা সর্বক্ষণ তাকে খ্যাপায়। প্যালারাম ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় চার মূর্তির কীর্তিকাহিনি নিয়ে উপন্যাস লেখে। তবে দলের মধ্যে বুদ্ধি এবং সাহসে সব থেকে এগিয়ে ক্যাবলা, তার আসল নাম কুশল মিত্র। ম্যাট্রিকে এক চান্সে স্টার পাওয়া ক্যাবলাই সমস্ত রহস্যভেদের পিছনে আসল মাথা ৷

পড়াশোনায় টেনিদা একেবারেই অষ্টরম্ভা। তিন-তিনবার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেলের পর অবশেষে থার্ড ডিভিশনে পাশ করে বয়সে ছোটো প্যালা, হাবুল আর ক্যাবলার সঙ্গেই একত্রে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছোয় কলেজে। তবে পড়াশোনার ভালো না হলেও ফুটবল-ক্রিকেটে টেনিদা সবসময় পটলডাঙার থান্ডার ক্লাবের ক্যাপটেন। এমনকি দধীচি, পোকা ও বিশ্বকর্মা’ গল্পে থিয়েটারে বিশ্বকর্মারূপী টেনিদার কার্যকলাপ আমাদের হাসির খোরাক জোগায়।

পটলডাঙা স্ট্রিটের চাটুজ্জেদের রোয়াক টেনিদা-সহ চার মূর্তির অত্যন্ত প্রিয় আড্ডার জায়গা। বিভিন্ন উদ্ভট প্ল্যান, এলোমেলো বহু তর্কবিতর্কের নীরব সাক্ষী এই রোয়াক। এখানে বসেই কখনও ডালমুট, কখনও তেলেভাজা চিবোতে চিবোতে টেনিদা মনের সুখে মিথ্যে আবোল-তাবোল গল্পে মাতিয়ে রাখত বাকিদের। সেইসব সূত্র ধরে আসত টেনিদার কুট্টিমামা, খড়গপুরের মামার বাড়ি তেলিনী পাড়ার মোক্ষদামাসির প্রসঙ্গ। কখনও আবার টেনিদার বিখ্যাত অতিসাহসের গল্পকাহিনি। টেনিদা সেইসব মিথ্যে গল্পকে অদ্ভুত শক্তিতে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারত। ভাষার প্রয়োগে অসাধারণ দক্ষতা ছিল তার। রেগে গেলে তার প্রবচনগুলি হত অভিমুখশ্রাব্য-কুরবন্ধের মতো বকবক করা, কান ছিঁড়ে কানপুরে পাঠানো, দাঁত পাঠানো দাঁতনে, নাক পাঠানো নাসিকে ইত্যাদি। টেনিদার কাছে অতি ঘোরালো ব্যাপার মানে পুঁদিচ্চেরি। টেনিদাকে ভীতু বলায় টেনিদার উত্তর—“কী, আমি ভিতু। … সাহস। নেই…..আছে কি না দেখবি কাল। বাঘ-ভালুক-হাতি-গণ্ডার যে সামনে আসবে, এক ঘুষিতে তাকে ফ্ল্যাট করে দেব।” শুধু বড়ো বড়ো কথাই নয়, এলোমেলো যুক্তি প্রয়োগ করে লোককে চুপ করিয়ে দিতেও সে ওস্তাদ। যেমন প্যালাকে ‘ক্রিকেট মানে ঝিনি’ গল্পে ক্রিকেট মাঠে জোর করে নামিয়ে দেওয়ার আগে টেনিদার উক্তি….ইটিতে না পারলে দৌড়নো যায় না? কেন যায় না শুনি? তাহলে মাথা না থাকলেও কী করে মাথাব্যথা হয়। নাক না ডাকলেও লোকে ঘুমায় কী করে? ..

এটিও পড়ুন :  মিশর রহস্য গ্রন্থ সমালোচনা প্রকল্প - Bengali Project

টেনিদা তার তিন চ্যালার কাছে নিজেকে বীর প্রমাণ করতে চাইলেও আদতে ছিল খুব ভীতু। উপন্যাস-গল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা টেনিদাকে ভয় পেতে দেখেছি। যদিও সেটা সে হাবেভাবে কিছুতেই প্রকাশ করত না। তবে সত্যিকারের বিপদের মুখে টেনিদার সাহসের পরিচয়ও পাই- “গড়ের মাঠে গোরা ঠেঙিয়ে স্বনামধন্য। হাত তুললেই মনে হবে রদ্দা মারলে, দাঁত বার করলেই বোধ হবে কামড়ে দিলে বোধহয়।” অনেক গল্পে টেনিদা জুজুৎসু প্যাঁচ দিয়ে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করেছে—” বেচারা দোকানদার টেনিদাকে চেনে না। সঙ্গে সঙ্গে জুজুৎসুর এক প্যাঁচে তিন হাত দূরে ছিটকে চলে গেল।….. আর বেমালুম ঘুষি চালিয়ে ফ্ল্যাট করে ফেলেছে গোটা তিনেক লোককে।”

তবে টেনিদা চরিত্রের সবথেকে নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য হল তার খাদ্যপ্রীতি। যে-কোনো খাদ্যবস্তুর প্রতি টেনিদার আকর্ষণ বিশেষ ভালোমন্দ কোনো খাবারেই তার অরুচি নেই। ‘চার মূর্তি’ উপন্যাসে বর্ণনা রয়েছে- “…. টেনিদার খাওয়ার বহর দেখে মনে হচ্ছিল, এর পরে ও আর এমনি উঠতে পারবে না— ক্রেনে করে তুলতে হবে। সের-দুই মাংসের সঙ্গে ডজন খানেক কাটলেট তো খেলই—এরপর প্লেট-ফ্রেটসুস্থ খেতে আরম্ভ করবে এমনি আমার মনে হল।” চাটুজ্জেদের বিখ্যাত রোয়াকে বসে টেনিদার অন্যের ঘাড় ভেঙে ডালমুট, তেলেভাজা, আচার, আমসত্ত্ব, কুলফি ইত্যাদি খাওয়ার কথা প্রায় প্রতিটি গল্পে পাওয়া যায়। শুধু অন্যের টাকাতেই নয়, তিন জনের খাদ্যবস্তু ছোঁ মেরে হরণ করে খাওয়াও টেনিদার স্বভাব। পেটরোগা প্যালাজ্বরের রোগী প্যালা তার সর্বাপেক্ষা সহজ শিকার। নিজের ভাগের আলুকাবলি, রাজভোগ থেকে প্যালা বর্ণিত হয়েছে একাধিকবার শুধুমাত্র টেনিদার সৌজন্যে।

বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী এইরকম ভৈরব ভয়ংকর’ টেনিদা চরিত্রটি শুধুই কি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কল্পনা? নাকি কোনো রক্তমাংসের বাস্তব চরিত্রকে দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন? আসলে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ২০ নম্বর পটলডাঙা স্ট্রিটের বাড়িতে ভাড়া আসেন। এই বাড়ির মালিক ছিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। বাড়িওয়ালার সঙ্গে লেখকের খুব ঘনিষ্ঠ মেলামেশা ছিল এবং সম্ভবত তাকে সামনে রেখেই তিনি টেনিদা চরিত্রটি অঙ্কন করেছিলেন। অর্থাৎ বাস্তব আর কল্পনার মিশেলেই গড়ে উঠেছে আমাদের অতি প্রিয় টেনিদা ৷ তবে বাকি তিন মূর্তির নামের সঙ্গে বাস্তব চরিত্রের নামের কিছু মিল থাকলেও চরিত্রগুলি সম্পূর্ণভাবেই কাল্পনিক।

এটিও পড়ুন :  নির্বাচিত সাহিত্য সৃষ্ট চরিত্রের জীবনী নির্মাণ প্রকল্প প্রফেসর শঙ্কু | Class 12 Bengali Project

টেনিদা শুধু বইয়ের দু-মলাটের মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি। বাঙালিদের মধ্যে তার বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে টেনিদা ও তার টিমকে নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা এবং কার্টুন। অর্থাৎ একুশ শতকে স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান, ডেরোমন, হ্যারি পটারদের পাশাপাশি কলকাতার পটলডাঙার চার মূর্তি আজও অজস্র বাঙালি হৃদয়ের সিংহভাগ যেভাবে অধিকার করে রয়েছে, তা দেখলে টেনিদা আনন্দের চোটে নিশ্চয়ই চিৎকার করে বলত- ‘ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস।’ আর তার থেকেও জোরে বাকি তিন মূর্তি বলত —— -“ইয়াক্ ইয়াক্’।

About the Author

Admin