[ সূত্রাবলি: ভূমিকা – সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান – বিজ্ঞান শক্তির পরস্পর বিরোধী দুই চিত্র – মানুষের কপটবুদ্ধি ও বিজ্ঞানীর নিষ্কাম ধর্ম- উপসংহার।]
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা
ভূমিকা: মানব সভ্যতার অগ্রগতি ও বিজ্ঞান সমার্থক। প্রাগৈতিহাসিক মানুষ ছিল নিতান্তই প্রকৃতিনির্ভর। প্রকৃতির নির্মম ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা, প্রচণ্ড খরা, ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আদিম মানবজীবন ক্ষণে ক্ষণে লন্ডভন্ড হয়েছে। বিজ্ঞান বুদ্ধিকে আশ্রয় না করে মানুষ তখন শুধু দৈহিক শক্তির সাহায্যে বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করত। কিন্তু মানুষ যেদিন আগুন জ্বালতে শিখল সেদিন থেকেই বিজ্ঞানের যাত্রা হল শুরু। আর সেদিনই বিজ্ঞানের সঙ্গে সভ্যতার গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেল চিরন্তন। ক্রমে চাষ, স্থায়ী বসবাস, নগরপত্তন, উদ্বৃত্ত উৎপাদন বিনিময়, ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা নির্মাণ, উন্নত যানবাহন ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ আজ জল-স্থল-অন্তরীক্ষে নিঃসপত্ন আধিপত্য বিস্তার করেছে। সবই সে করেছে বিজ্ঞান অস্ত্রে মহা বলীয়ান হয়ে। এইভাবেই মানব সভ্যতা ও বিজ্ঞান যুগপৎ আজ এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে।
সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান: আমাদের দৈনন্দিন জীবন একান্তই বিজ্ঞান নির্ভর। সকালে ঘড়ির অ্যালার্মে ঘুম ভাঙা থেকে শুরু করে শুতে যাওয়া পর্যন্ত এমন কি শোবার পরেও পাখা ইত্যাদির সাহায্যে যে সব পরিষেবা পাই তা সবই বিজ্ঞান নির্ভর।
শিক্ষাক্ষেত্রে: এমনিভাবে খাতা, কলম, বই, পেন্সিল, ক্যালকুলেটার, রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার ইত্যাদি সকল শিক্ষা উপকরণ বিজ্ঞান নির্ভর।
কৃষিতে: কৃষিকাজও আজ বিজ্ঞান নির্ভর। পাওয়ার টিলার, ঝাড়াই-মাড়াই মেশিন, সেচের পাম্প, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার-এ সবই আজ একান্তই কৃষি-বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে: বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টীকা, বিভিন্ন মারণ রোগের অব্যর্থ বিজ্ঞান নির্ভর চিকিৎসা, কিডনী প্রতিস্থাপন, হার্ট-সার্জারী, টেস্ট টিউব বেবী ইত্যাদি সবই আজ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লবের সাক্ষী।
ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে: একইভাবে পাহাড় কেটে টানেল পথ নির্মাণ, সেতু, বড় বড় কলকারখানা, কত শত আধুনিক দৈত্যাকার ও অতি সুক্ষ্ম যন্ত্রপাতি, শত সহস্র আধুনিক ইমারৎ সবই আজ নির্মিত হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানের বিচিত্র কলা কৌশলে।
বিজ্ঞান শক্তির পরস্পর বিরোধী দুই চিত্র: তবে প্রশ্ন হচ্ছে বিজ্ঞানের সব অবদানই কি কল্যাণী? বিজ্ঞানের এক হাতে যেমন কল্যাণের বরাভয় তেমনি অপর হাতে তার ফধ্বংসের তাণ্ডব লীলা। ১৯৪৫ সালের বিজ্ঞান প্রসূত দু’টি পরস্পর বিরোধী ঘটনার কথাই এখানে উল্লেখযোগ্য। ঐ বছরেই একদিকে যেমন হিরোসিমা-নাগাসাকিতে দুটি পারমাণবিক বোমা ফাটিয়ে লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু ঘটানো হল, তেমনি অপরদিকে মৃত্যুপথযাত্রীদের জন্য জীবনদায়ী ওষুধ ও পেনিসিলিন আবিষ্কার করলেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। এখন বিজ্ঞানের এই দুই রূপ-শিব ও রুদ্রের মধ্যে কোনটিকে মেনে নেব আমরা? কোটিই বা বিজ্ঞান বিদ্যার সঠিক স্বরূপ? নিশ্চয়ই বিজ্ঞানের কল্যাণ সুন্দর রূপকেই ধরতে হবে।
মানুষের কপটবুদ্ধি ও বিজ্ঞানীর নিষ্কাম ধর্ম: পারমাণবিক অস্ত্রই হোক বা ক্ষেপণাস্ত্রের মত আধুনিক দূর নিয়ন্ত্রিত মারণাস্ত্রই হোক তার জন্য বিজ্ঞানকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। বিজ্ঞানের ধর্ম নিষ্কাম কর্ম। গবেষণালব্ধ সত্যকে সকলের মধ্যে ব্যাপ্ত করে দিয়ে বিজ্ঞানের পরিতুষ্টি। মানুষ সেই সত্যকে কীভাবে মানব সমাজে প্রয়োগ করবে তার উপরেই নির্ভর করছে বিজ্ঞানের কল্যাণকর বা ধ্বংসকারী ভূমিকা। এর জন্য বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীর দায় কী?
উপসংহার: আজ বিজ্ঞানের রুদ্র-সংহার মূর্তি দেখে, তার সর্বগ্রাসী যান্ত্রিক নিষ্প্রাণতা উপলব্ধি করে মানুষ বিজ্ঞানকে যতই দোষারোপ বা কলঙ্কলিপ্ত করুক না কেন সে দোষ বিজ্ঞানের নয়। দোষ মানুষের। কারণ মানুষের বিকৃত-বিলাসে কল্যাণপ্রসূ বিজ্ঞান পরিণত হয় ধ্বংসের অভিশাপে। তবে বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রা উন্নয়ন না ধ্বংসসাধন, কোন্ পথে- তা বিচার করবে মহাকাল।
- এই প্রবন্ধের অনুসরণে লেখা যেতে পারে – বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতা নামক প্রবন্ধটি