ধান চাষের অনুকূল পরিবেশ: ধান ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য, যা কোটি কোটি মানুষের প্রধান আহার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে ধানচাষের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন, এবং এটি কৃষিজ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। ধান চাষের উৎপাদনশীলতা সরাসরি নির্ভর করে প্রাকৃতিক পরিবেশ, মাটি, জলবায়ু এবং সেচব্যবস্থার উপর। সঠিক পরিবেশ না পেলে ধানের গুণগত মান ও ফলন উভয়ই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই কারণে, ধান চাষের অনুকূল পরিবেশ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকা কৃষক, কৃষি-বিজ্ঞানী এবং নীতি-নির্ধারকদের জন্য অপরিহার্য। নিচে ধান চাষের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি পরিবেশগত উপাদান বিশদভাবে আলোচিত হল।
(১) ভৌগোলিক অবস্থা
জলবায়ু: ধান ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের ফসল। সাধারণত ধান চাষের জন্য ২০°C থেকে ৩৫°C তাপমাত্রা সর্বাধিক উপযোগী। চারা রোপণের সময় ২০°C–২৫°C এবং শীষ গঠনের সময় প্রায় ২৫°C–৩০°C তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। অতিরিক্ত ঠান্ডা বা তীব্র গরম ধানের বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ভারতে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা, অন্ধ্র প্রদেশ ও তামিলনাড়ু প্রদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু ধান চাষের জন্য বিশেষভাবে অনুকূল।
বৃষ্টিপাত: বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বছরে 100 থেকে 200 সেমি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ধানের চারা বড়ো হওয়ার সময় প্রতি মাসে 12 সেমি বৃষ্টিপাত হলে ফসল খুব ভালো হয়। তবে ধান পাকার সময় শুষ্ক ও রোদ ঝলমলে আবহাওয়া থাকা প্রয়োজন। বর্ষার সময় নিয়মিত ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ধানের চারা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। তবে বৃষ্টিপাতের সঠিক সময়কালও সমান গুরুত্বপূর্ণ—বপন থেকে শীষ গঠন পর্যন্ত নিয়মিত জল সরবরাহ না হলে ফলন হ্রাস পায়। ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক বৃষ্টিপাতের প্রাচুর্য ধান চাষকে সহজ করে তোলে।
মৃত্তিকা: ধান চাষের জন্য উর্বর মৃত্তিকার প্রয়োজন। নদী-উপত্যকার উর্বর পলিমাটিতে ধান ভালো হয়। ধান চাষের প্রাথমিক অবস্থায় জমিতে জল জমে থাকা একান্ত প্রয়োজন। এই কারণে উর্বর দোআঁশ-পলিমাটি স্তরের প্রায় 1 মিটার নীচে অপ্রবেশ্য কাদামাটির স্তর থাকা বাঞ্ছনীয়, যাতে জল মৃত্তিকাস্তরের গভীরে না গিয়ে ওপরের স্তরে জমে থাকে।
ভূমির অবস্থা: ধান চাষের জন্য সমতলভূমি বিশেষ উপযুক্ত, যাতে জমিতে বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখা সম্ভব হয়। এই কারণে নদী-উপত্যকা ও বদ্বীপের নীচু অঞ্চলগুলি পৃথিবীর ধান চাষের প্রধান ক্ষেত্র।
(২) অর্থনৈতিক অবস্থা
শ্রমিক: ধান চাষের জন্য জমিতে লাঙল দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার করা, ধানের চারাকে স্থানান্তর করে রোপণ করা, ফসল কাটা প্রভৃতি যাবতীয় কাজ প্রধানত হাতেই করা হয়। ফলে ধান চাষের জন্য প্রচুর সুলভ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
মূলধন: হেক্টর-প্রতি ধান উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য উচ্চফলনশীল বীজ, সার ও সেচের ব্যবহারের দ্বারা নিবিড় প্রথায় চাষ করতে হলে যথেষ্ট মূলধনের প্রয়োজন হয়।
চাহিদা বা বাজার: যে অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য চাল, সেই অঞ্চলে অন্য খাদ্যফসলের তুলনায় ধানের বেশি চাহিদা থাকায় ধান উৎপাদনই অগ্রাধিকার পায়।
ধানের ব্যবহার
- ধানের খোসা ছাড়িয়ে চাল প্রস্তুত করা হয়। চাল পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষের প্রধান খাদ্য।
- এ ছাড়া চিড়ে, মুড়ি, খই, শ্বেতসার ইত্যাদি তৈরিতে ধান কাজে লাগে।
- ধানের তুষ থেকে নিষ্কাশন করা হয় ভোজ্য তেল।
- গ্রামাঞ্চলে ঘরের ছাউনি তৈরিতে খড় ব্যবহৃত হয়।
- এ ছাড়া দড়ি, কাগজ শিল্পের কাঁচামাল ও জ্বালানি হিসেবেও খড় ব্যবহৃত হয়।
- খড় একটি পশুখাদ্য।
- বর্তমানে ধানের খোসা সিমেন্টের সঙ্গে মিশিয়ে শব্দ-নিরোধক দেয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে।
ধান চাষের সফলতা সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক পরিবেশ, সেচব্যবস্থা এবং কৃষি প্রযুক্তির সুষম সমন্বয়ের উপর নির্ভরশীল। জলবায়ু, মাটি, বৃষ্টিপাত, সেচ ও সূর্যালোক—প্রতিটি উপাদান সঠিক অনুপাতে উপস্থিত থাকলেই উন্নত মানের ধান উৎপাদন সম্ভব হয়।












