চা উৎপাদনের অনুকূল অবস্থা: চা মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের পার্বত্য ও উচ্চভূমির ফসল। এটি শুধু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়, বরং দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক পরিচিতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ, যেখানে আসাম, দার্জিলিং, দোয়ারস এবং নীলগিরির চা বিশেষভাবে বিশ্বখ্যাত। তবে এই শিল্পের সাফল্য কেবল মানবিক শ্রম বা প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল নয়; বরং এর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত রয়েছে প্রকৃতির দান—যেমন উপযুক্ত জলবায়ু, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, অনুকূল ভূপ্রকৃতি, উর্বর মাটি এবং শ্রমশক্তির প্রাপ্যতা। ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক পরিবেশ চা উৎপাদনকে করেছে বহুমুখী ও বিশ্বমানে সমৃদ্ধ। চা চাষের অনুকূল অবস্থাগুলি হল-
চা উৎপাদনের ভৌগোলিক পরিবেশ
১. জলবায়ু ও তাপমাত্রা: চা গাছ মূলত উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে ভালো জন্মায়। বার্ষিক গড় তাপমাত্রা যদি ২০° সেলসিয়াস থেকে ৩০° সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে, তবে চা গাছের বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়। অতিরিক্ত ঠান্ডা বা শুষ্ক আবহাওয়া চাষের পক্ষে ক্ষতিকর। ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং অঞ্চলে বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টি হয়, আর শীতকালে আবহাওয়া থাকে শীতল ও কুয়াশাচ্ছন্ন—যা চা পাতার সুবাস ও গুণমান বৃদ্ধি করে।
উদাহরণস্বরূপ, দার্জিলিং-এর চা তার সুগন্ধি ও স্বাদের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে “শ্যাম্পেন অব টি” নামে খ্যাত। জলবায়ুর এই বিশেষত্ব চা উৎপাদনে ভারতের অন্যতম শক্তি।
২. বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা: চা গাছ সারা বছর পর্যাপ্ত আর্দ্রতা প্রয়োজন করে। বছরে প্রায় ১৫০ থেকে ৩০০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হলে চা উৎপাদন বিশেষভাবে অনুকূল হয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি, বিশেষ করে আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়, মৌসুমি বায়ুর কারণে প্রচুর বৃষ্টিপাত পায়। এর ফলে চা গাছ পর্যাপ্ত পানি সঞ্চয় করতে পারে এবং গ্রীষ্মকালে শুষ্কতা থেকেও রক্ষা পায়। তবে বৃষ্টিপাত সমানভাবে বণ্টিত না হলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, যা শিকড় পচনের কারণ হতে পারে। তাই এসব অঞ্চলে পাহাড়ি ঢালে বা উঁচু ভূমিতে চা চাষ করা হয় যাতে পানি জমে না থাকে। এই অনুকূল বৃষ্টিপাত ভারতের চা শিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক করেছে।
৩. মাটির প্রকৃতি: উর্বর, ঝুরঝুরে ও সামান্য অম্লধর্মী (pH ৪.৫-৫.৫) মাটি চা গাছের বৃদ্ধির জন্য সর্বাধিক উপযোগী। মাটিতে জল নিঃসরণের ভালো ব্যবস্থা থাকতে হয় যাতে অতিরিক্ত জল শিকড়ে ক্ষতি না করে। ভারতের দার্জিলিং পাহাড়ে হিউমাস সমৃদ্ধ দোআঁশ মাটি পাওয়া যায়, যা চা গাছের জন্য একেবারে আদর্শ। অন্যদিকে, আসামের পলিমাটি তার উর্বরতার কারণে বৃহৎ পরিসরে চা উৎপাদনকে সম্ভব করেছে। নীলগিরি অঞ্চলের লাল মাটিও চা চাষের জন্য বিশেষ উপযুক্ত। বিভিন্ন অঞ্চলের মাটির বৈচিত্র্যের কারণে ভারতীয় চায়ের স্বাদ, রং ও সুবাসে ভিন্নতা দেখা যায়, যা আন্তর্জাতিক বাজারে আলাদা পরিচিতি তৈরি করেছে।
৪. ভূপ্রকৃতি ও অবস্থান: চা চাষ প্রধানত পাহাড়ি ঢালে ও উচ্চভূমিতে বেশি সফল হয়। কারণ এসব অঞ্চলে জলাবদ্ধতা হয় না এবং সূর্যালোকের সঠিক প্রবেশ ঘটে। দার্জিলিং পাহাড় প্রায় ৬০০ থেকে ২০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, যেখানে ঠান্ডা-আর্দ্র জলবায়ু ও ঢালু ভূমি চা উৎপাদনে অপরিহার্য পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আসামের সমতলভূমিতেও চা চাষ হয়, তবে পাহাড়ি চায়ের তুলনায় এর গুণমান কিছুটা আলাদা। দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পাহাড়ে চা চাষ একইভাবে বিশ্বখ্যাত। উচ্চতার কারণে এই অঞ্চলের চায়ে বিশেষ সুবাস ও স্বাদ পাওয়া যায়, যা ভারতের চা শিল্পের বৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
চা উৎপাদনের অর্থনৈতিক পরিবেশ
১. শ্রমিক: হাত দিয়ে বেছে বেছে চা-পাতা তুলতে হয় বলে চা চাষে প্রচুর সুলভ ও নিপুণ শ্রমিকের প্রযোজন। শ্রমিকের নৈপুণ্যের ওপর চায়ের গুণাগুণ অনেকটা নির্ভর করে। কারণ, দুটি পাতা ও একটি কুঁড়ি (Two Leaves and a Bud) ঠিকমতো চয়ন করতে না পারলে চায়ের উৎকর্ষতা কমে যায়। এসব কাজের জন্য সরু আঙুল বিশেষ সুবিধাজনক বলে চা বাগানে শিশু এবং নারী শ্রমিক নিয়োগ। করা হয়। স্বাভাবিকভাবে বাড়তে দিলে চা গাছ 6-7 মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। কিন্তু পাতা তোলার সুবিধার জন্য একে ছেঁটে সব সময় 1 মিটারের মধ্যে রাখা হয়, যাতে হাতের নাগালের মধ্যে পাতাগুলি থাকে। এভাবে গাছ ছাঁটার ফলে নতুন পাতা বের হয় এবং এই নতুন পাতাই পানীয় চায়ের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে।
২. মূলধন: প্রতিযোগিতামূলক বাজারে উৎপাদনের গুণমান ও উৎকর্ষ বজায় রাখার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হয়। এই কারণে সার, কীটনাশক, বাগিচা রক্ষণাবেক্ষণ, শ্রমিকের মজুরি ইত্যাদি বাবদ প্রচুর মূলধন বিনিয়োগের প্রযোজন হয়।
৩. পরিবহন ও বাজারব্যবস্থা: চা একটি দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়া দ্রব্য, তাই এর বাজারজাতকরণের জন্য দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থা অপরিহার্য। ভারতের আসাম ও দার্জিলিং অঞ্চলে রেলপথ, নদীপথ ও সড়কপথের উন্নয়ন চা শিল্পকে প্রসারিত করতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে চা পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হতো। আজও রেল ও সড়কপথ চা শিল্পের প্রাণশক্তি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কলকাতা ও গুয়াহাটি বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর ফলে ভারতের উৎপাদিত চা দ্রুত বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হয়। এভাবে পরিবহন ও বাজারব্যবস্থা চা উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশকে আরও সুসংহত করেছে।
সাধারণত বাগিচা-ফসলের ক্ষেত্রে বাগানের ভেতরেই পণ্য বাজারজাত করার সব ধরনের বন্দোবস্ত করা হয়। বড়ো বড়ো। চা বাগানে এই কারণেই চায়ের পাতা শুকোনো, সেঁকা, গুণানুসারে পাতা বাছাই, বাক্সবন্দি করে বাজারে পাঠানো প্রভৃতি কাজ বাগানের ভেতরেই করা হয়ে থাকে।