ভারতে কফি চাষের অনুকূল পরিবেশ সম্বন্ধে আলোচনা করো।

কফি চাষের উপযুক্ত ভৌগােলিক পরিবেশ সম্পর্কে আলােচনা করাে | ভারতে কফি চাষের অনুকূল পরিবেশ সম্বন্ধে আলোচনা করো।
Photo of author
Bishal Roy

Published On:

কফি চাষের অনুকূল পরিবেশ: কফি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে একটি বহুল চাহিদাসম্পন্ন বাণিজ্যিক ফসল। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার বেশ কিছু দেশে কফি উৎপাদন হয়ে থাকে, তবে ভারতের দক্ষিণাঞ্চল কফি চাষের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। কর্ণাটক, কেরালা ও তামিলনাড়ুর পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে কফি চাষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব বহন করে। কফি চাষ একটি সংবেদনশীল প্রক্রিয়া, কারণ এর সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে পরিবেশগত উপাদানগুলোর ওপর। জলবায়ু, মাটি, বৃষ্টিপাত, উচ্চতা, ছায়া ও তাপমাত্রা—এই সবকিছু মিলে কফি চাষকে সফল করে তোলে।

কফি ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলের ফসল। কফি চাষের অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশগুলি হল-

প্রাকৃতিক পরিবেশ:

জলবায়ু: কফি গাছ নাতিশীতোষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে ভালো জন্মায়। সাধারণত ১৫° সেলসিয়াস থেকে ২৮° সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা কফি চাষের জন্য আদর্শ বলে বিবেচিত হয়। অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া কফি গাছের ফুল ও ফলকে নষ্ট করে দেয়, আবার অত্যধিক ঠান্ডা তুষারপাত কফি গাছের ক্ষতি সাধন করে। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা বরাবর বিস্তৃত অঞ্চলে এই ধরনের জলবায়ু পাওয়া যায়, যা কফি চাষকে সাফল্যমণ্ডিত করেছে।

উদাহরণস্বরূপ, কর্ণাটকের কুর্গ জেলা কফি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত, কারণ সেখানকার মৃদু আবহাওয়া ও স্থিতিশীল তাপমাত্রা গাছকে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়। তাই জলবায়ু কফি চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা: কফি গাছ পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ছাড়া সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারে না। বার্ষিক গড়ে ১৫০০ থেকে ২৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত কফি চাষের জন্য উপযোগী। তবে এই বৃষ্টিপাত ধারাবাহিকভাবে হওয়া জরুরি, যাতে মাটি আর্দ্র থাকে কিন্তু অতিরিক্ত জলাবদ্ধ না হয়। ভারতবর্ষের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টি পায়, যা কফি গাছের শিকড়ে আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। বিশেষত আরাবিকা প্রজাতির কফি নিয়মিত আর্দ্রতা প্রয়োজন, অন্যদিকে রোবাস্টা প্রজাতি কিছুটা খরাপ্রবণ অঞ্চলও সহ্য করতে পারে।

এটিও পড়ুন :  জেট স্ট্রিমের শ্রেণিবিভাগ করো। জিওস্ট্রফিক বায়ু বলতে কী বোঝ?

উদাহরণ হিসেবে কেরালার ওয়েনাড় অঞ্চলে সঠিক বৃষ্টিপাত কফি চাষকে টেকসই করে তুলেছে। তাই বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা কফি চাষের একটি অপরিহার্য পরিবেশগত শর্ত।

মাটি: কফি গাছের জন্য উর্বর, গভীর এবং জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ মাটি অপরিহার্য। সাধারণত ল্যাটেরাইট, লাল এবং দোআঁশ মাটি কফি চাষের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। মাটির pH মান ৬ থেকে ৬.৫-এর মধ্যে হলে কফি গাছ সুস্থভাবে বৃদ্ধি পায়। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের পাহাড়ি ঢালে পাওয়া লাল মাটি জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ এবং পানি নিঃসরণের জন্য উপযোগী, ফলে কফি গাছের শিকড় অক্সিজেন পায়।

উদাহরণস্বরূপ, কুর্গ ও চিকমাগালুর অঞ্চলের মাটি প্রাকৃতিকভাবে উর্বর, যা বহু দশক ধরে কফি উৎপাদনকে সমর্থন করছে। সঠিক মাটি কেবল উৎপাদন বাড়ায় না, বরং কফির স্বাদ ও গুণগত মানকেও প্রভাবিত করে।

উচ্চতা: কফি চাষের ক্ষেত্রে উচ্চতা একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০০ মিটার থেকে ১৮০০ মিটার উচ্চতা কফি চাষের জন্য আদর্শ। উচ্চভূমিতে তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত শীতল থাকে এবং বাতাসে আর্দ্রতা বজায় থাকে, যা কফি গাছকে সঠিকভাবে বিকশিত হতে সাহায্য করে। আরাবিকা প্রজাতি সাধারণত বেশি উচ্চতায় ভালো জন্মায়, যেখানে এর স্বাদ আরও মসৃণ হয়। অন্যদিকে রোবাস্টা তুলনামূলকভাবে কম উচ্চতায় জন্মাতে সক্ষম। ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ও নীলগিরি পাহাড় এই উচ্চতার পরিসরে পড়ে, ফলে এই অঞ্চলগুলো কফি চাষের জন্য বিশেষভাবে অনুকূল। উচ্চতার প্রভাব শুধু উৎপাদনশীলতায় নয়, কফির সুবাস ও স্বাদেও প্রতিফলিত হয়।

অর্থনৈতিক পরিবেশ:

শ্রমিক: কফি বাগিচায় গাছ লাগানো, আগাছা পরিষ্কার করা, পরিচর্যা করা, কীটনাশক ওষুধ প্রয়োগ, কফি গাছের ফল তোলা, ভাজা ও গুঁড়ো করা ইত্যাদি কাজের জন্য প্রচুর সুলভও দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।

এটিও পড়ুন :  প্রতীপ ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি ও গঠন আলোচনা করো। প্রতীপ ঘূর্ণবাতের বৈশিষ্ট্য লেখো।

মূলধন: কফি চাষ একটি শ্রম-নিবিড় কার্যকলাপ। কফির বাগিচা প্রস্তুত থেকে বাজারে কফি পাঠানো পর্যন্ত প্রতিটি কাজেই প্রচুর মূলধন দরকার হয়।

পরিবহণ: কফি একটি অর্থকরী বা বাণিজ্যিক ফসল। এই ফসল উৎপাদনের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজারজাতকরণের ওপর। সুতরাং, কফির বাগিচা ও বিক্রয়কেন্দ্রগুলির মধ্যে উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠা প্রযোজন।

চাহিদা বা বাজার: কফির মতো বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদনে চাহিদা বা বাজারের ভূমিকাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় কফির চাহিদা অন্তর্দেশীয় বাজারের তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি। এই কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কফির দাম হ্রাস পেলে ফসল উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনাও দেখা দেয়।

সার্বিকভাবে দেখা যায়, কফি চাষ একটি সূক্ষ্ম ও পরিবেশনির্ভর প্রক্রিয়া। সঠিক জলবায়ু, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, উর্বর মাটি, উপযুক্ত উচ্চতা এবং প্রয়োজনীয় ছায়া না থাকলে কফি চাষ সফল হয় না। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য এই সকল শর্ত পূরণ করে, ফলে দেশটি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কফি উৎপাদক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও কফি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠেছে।

Leave a Comment