গ্রামীণ উন্নয়নে অ-কৃষি খাতের ধারণা ও গুরুত্ব | Concept and importance of non-farm sector in rural development

গ্রামীণ উন্নয়নের পরিপূর্ণতা শুধুমাত্র কৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভরশীল নয়। কৃষি অবশ্যই গ্রামীণ জীবনের মেরুদণ্ড, তবে আধুনিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে অ-কৃষি খাত ... Read more
Photo of author
Bishal Roy

Published On:

গ্রামীণ উন্নয়নের পরিপূর্ণতা শুধুমাত্র কৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভরশীল নয়। কৃষি অবশ্যই গ্রামীণ জীবনের মেরুদণ্ড, তবে আধুনিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে অ-কৃষি খাত (Non-Farm Sector) ক্রমেই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অ-কৃষি খাত বলতে এমন সকল উৎপাদন ও পরিষেবা কার্যক্রমকে বোঝায় যা কৃষির সরাসরি অন্তর্ভুক্ত নয়, যেমন—গ্রামীণ ক্ষুদ্র শিল্প, হস্তশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, গ্রামীণ পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন, নির্মাণ ইত্যাদি। ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোয় এই খাতের বিকাশ কেবল আয়ের পরিধি বাড়ায় না, বরং জীবনমান উন্নত করে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং কৃষির উপর অতিরিক্ত চাপ হ্রাস করে। এই প্রবন্ধে অ-কৃষি খাতের ধারণা, ভূমিকা ও গুরুত্ব ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ করা হবে।

অ-কৃষি খাতের ধারণা ও পরিধি

অ-কৃষি খাত মূলত গ্রামীণ জীবনে কৃষির বাইরে থাকা সমস্ত আয়ের উৎসকে অন্তর্ভুক্ত করে। এতে যেমন গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (MSME), গৃহভিত্তিক শিল্প, হস্তশিল্প, তাঁত শিল্প, কাঠ ও ধাতব শিল্প রয়েছে, তেমনি রয়েছে গ্রামীণ পরিবহন ব্যবস্থা, নির্মাণকাজ, খুচরা ব্যবসা, আর্থিক পরিষেবা এবং পর্যটন খাতও। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনের বালুচরি শাড়ি শিল্প বা রাজস্থানের পটচিত্রশিল্প গ্রামীণ অ-কৃষি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই খাত কৃষিভিত্তিক অঞ্চলের সাথে শহুরে বাজারের সংযোগ স্থাপন করে, যা একদিকে পণ্যের বাজার বিস্তৃত করে এবং অন্যদিকে গ্রামীণ মানুষের আয়ের উৎসকে বৈচিত্র্যময় করে।

এটিও পড়ুন :  গ্রামোন্নয়নের পন্থা (Approaches to Rural Development)

কৃষির উপর নির্ভরশীলতা কমানো

ভারতের অধিকাংশ গ্রামীণ পরিবার ঐতিহ্যগতভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল হলেও, ভূমি খণ্ডিতকরণ, মৌসুমি বেকারত্ব এবং কৃষিজ উৎপাদনে অনিশ্চয়তার কারণে শুধুমাত্র কৃষি থেকে স্থায়ী জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন। অ-কৃষি খাত কৃষির উপর এই অতিরিক্ত চাপ হ্রাস করে। উদাহরণস্বরূপ, শীতকালে কৃষি মৌসুম শেষ হলে বহু কৃষক পশ্চিমবঙ্গ বা মহারাষ্ট্রের গ্রামীণ নির্মাণ কাজে যুক্ত হয়ে বাড়তি আয় করেন। এর ফলে কৃষি মৌসুমের বাইরেও তারা অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকেন, যা জীবিকার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সম্প্রসারণ

ভারতের গ্রামীণ অঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অ-কৃষি খাত এই সমস্যার কার্যকর সমাধান প্রদান করে। ক্ষুদ্র শিল্প ও পরিষেবা খাতে শ্রমনির্ভর কার্যক্রম অনেক মানুষের জন্য জীবিকা তৈরি করে, বিশেষত নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য। যেমন, রাজস্থানের নীলকণ্ঠ মৃৎশিল্প বা উত্তরপ্রদেশের গ্লাসওয়ার্ক শিল্প গ্রামীণ মহিলাদের স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি করেছে। অ-কৃষি খাতে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা তুলনামূলকভাবে বৈচিত্র্যময় হওয়ায় কৃষির বাইরের দক্ষতাগুলি ব্যবহার করা সম্ভব হয়, যা সার্বিক কর্মসংস্থানের পরিধি বিস্তৃত করে।

গ্রামীণ আয়ের বৈচিত্র্য ও দারিদ্র্য হ্রাস

শুধুমাত্র কৃষি আয়ের উপর নির্ভরশীলতা দারিদ্র্যের ঝুঁকি বাড়ায়, কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা বা বন্যার মতো পরিস্থিতিতে কৃষিজ আয় হ্রাস পায়। অ-কৃষি খাত গ্রামীণ পরিবারের আয়কে বহুমুখী করে এই ঝুঁকি কমায়। যেমন, মহারাষ্ট্রের কোনো কৃষক পরিবার যদি হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তবে কৃষিজ আয় কমলেও হস্তশিল্প থেকে আয় বজায় থাকবে। এভাবে অ-কৃষি খাত আয়ের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়ক হয়।

গ্রামীণ শিল্পোন্নয়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন

অ-কৃষি খাতের প্রসারে গ্রামীণ এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়ন অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বিদ্যুৎ, সড়ক, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বাজার অবকাঠামোর উন্নতি কেবল শিল্পোন্নয়নই নয়, বরং সাধারণ গ্রামীণ জীবনের মানোন্নয়নেও ভূমিকা রাখে। যেমন, গুজরাটের কুটির শিল্পাঞ্চলে রাস্তা ও বিদ্যুৎ সংযোগ বৃদ্ধির ফলে শুধুমাত্র উৎপাদনশীলতা বেড়েছে তা নয়, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে গ্রামীণ উন্নয়ন এক সমন্বিত প্রক্রিয়ায় রূপ নেয়।

এটিও পড়ুন :  ভারতের গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচি: SGSY | Rural Development Programmes in India - SGSY

নারীর ক্ষমতায়নে অ-কৃষি খাতের ভূমিকা

অ-কৃষি খাত গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা গৃহভিত্তিক শিল্প, সেলাই, হস্তশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। এর ফলে তাদের পারিবারিক আয় বৃদ্ধি পায়, সামাজিক মর্যাদা উন্নত হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ে। উদাহরণস্বরূপ, অন্ধ্রপ্রদেশের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি (Self Help Groups) মহিলাদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করে তাদের নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করছে, যা গ্রামীণ সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়াচ্ছে।

প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সংযোজন

আধুনিক প্রযুক্তি অ-কৃষি খাতকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম (যেমন—Amazon, Flipkart, Government e-Marketplace) গ্রামীণ উৎপাদকদের শহুরে ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য বিক্রির সুযোগ দিচ্ছে। যেমন, উত্তরাখণ্ডের মধু উৎপাদকরা অনলাইনের মাধ্যমে সারা দেশে পণ্য বিক্রি করছেন, যা তাদের আয় বহুগুণ বাড়িয়েছে।

সরকারি নীতি ও সহায়তা

সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প যেমন—”প্রধানমন্ত্রী রোজগার সৃজন কর্মসূচি” (PMEGP), “দীনদয়াল অন্ত্যোদয় যোজনা – ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড মিশন” (DAY-NRLM), “স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া”, এবং “স্কিল ইন্ডিয়া”—অ-কৃষি খাতের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রশিক্ষণ, ঋণ ও বাজার সংযোগের মাধ্যমে এই প্রকল্পগুলি গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের বিকাশে সহায়ক হচ্ছে।

উপসংহার: ভারতের গ্রামীণ উন্নয়নে অ-কৃষি খাত এক অনিবার্য শক্তি। এটি কেবল কৃষির উপর চাপ হ্রাস করে না, বরং কর্মসংস্থান, আয়ের বৈচিত্র্য, নারী ক্ষমতায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনে সার্বিক অগ্রগতি ঘটায়। আধুনিক প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও নীতি-সমর্থনের মাধ্যমে অ-কৃষি খাতকে আরও প্রসারিত করা গেলে ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী ও টেকসই হয়ে উঠবে। সুতরাং, গ্রামীণ উন্নয়নের কৌশলে অ-কৃষি খাতকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা দেওয়া ভবিষ্যতের জন্য অত্যাবশ্যক।

এটিও পড়ুন :  ভারতের গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচি: SGSY | Rural Development Programmes in India - SGSY