অরণ্য ধ্বংসের কারণ ও ফলাফল: অরণ্য একটি প্রবাহমান ও পুনর্ভব প্রাকৃতিক সম্পদ যা মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সমাজ, অর্থনীতি ও পরিবেশকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে। এর গুরুত্ব বহুমুখী। তাই বণভূমিকে সবুজসোনা বলে। অরণ্যের প্রত্যক্ষ উপযোগিতার তুলনায় পরখ উপজহিত খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বহুলাংশে ক্রমাগত অরণ্য প্রাকৃতিক কারণে ও মানবিক কার্যবলীর ফলে ধ্বংস হচ্ছে।
অরণ্য বিনাশের হার: FAO (১৯৬০)-এর তথ্যানুসারে ১৯০০ সালে পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ৫০% বনাবৃত অঞ্চল ছিল যা হ্রাস পেয়ে ২০১৬ সালে ২৯.৬২% হয়েছে। ১৯৫০ সালে ক্রান্তীয় বনভূমি ২৫% (৭০০ কোটি হেক্টর) থেকে আজ মাত্র ৭% হয়েছে। গত শতকে মধ্য আমেরিকায় ২/৩ অংশ, ল্যাটিন আমেরিকা ও দ.-পূ. এশিয়ায় ১/৩ অংশ বনভূমি বিলুপ্ত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরে সংরক্ষিত বন ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো অরণ্য থাকবে না। স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশ ছাড়া ইউরোপের অধিকাংশ দেশে অরণ্য প্রায় নিশ্চিহ্ন। যুক্তরাষ্ট্রে অরণ্য উচ্চ অক্ষাংশ ও পার্বত্য অঞ্চলের দিকে সরে যাচ্ছে।
FAO (২০১৬)-এর তথ্য অনুসারে ১৯৯২ সালে ভারতে বনভূমি ছিল মোট স্থলভাগের ৩৬% যা বর্তমানে (২০১৬) ২১.৫৭%। বছরে ভারতে গড়ে ১৫ লক্ষ হেক্টর অরণ্য বিনষ্ট হয়। ফলে আগামী ২০ বছরে ভারত সম্পূর্ণরূপে অরণ্যহীন হওয়ার আশঙ্কা আছে ।
অরণ্য বিনাশের কারণ (Causes of Deforestation) :
বিশ্বজুড়ে বা আঞ্চলিকভাবে এই ব্যাপক অরণ্য সংহারের পেছনে প্রাকৃতিক ও আর্থ-সামাজিক বহু কারণ বিদ্যমান। যেমন –
(ক) প্রাকৃতিক কারণ:
নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে খুব অল্প সময়ে বিশাল আয়তনের বনভূমির বিনাশ হয়।
দাবানল: বজ্রপাত, গাছে গাছে ঘর্ষণ এবং মানুষের কুমচাষ, শুকনো লতাপাতায় জলন্ত বস্তু নিক্ষেপের ফলে বনভূমিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এভাবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, চিন, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়ার বিস্তীর্ণ অরণ্য সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।
ধস: অতিবৃষ্টি, ভূকম্পনের কারণে পর্বতের ঢালে বসের ফলে উচ্চভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নীচে নেমে এসে বনভূমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যেমন, অসমের শিলং সংলগ্ন বনভূমি ধাসে (১৯৫০)।
ভূমিকম্প ও সুনামি: ভূমিকম্পের ফলে বিশাল অরণ্য সমৃ্য অঞ্চল মাটির নীচে চাপা পড়ে এবং প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছাস বা সুনামির ফলে উপকূলীয় বনভূমি ধ্বংস হয়। যথা, ২০০৪ সালের সুনামিতে সুন্দরবনের প্রভূত ক্ষতি।
অগ্ন্যুৎপাত: উত্তপ্ত গলিত লাভা নির্গত হয়ে অরণ্যের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বৃক্ষরাশিকে নিমেষে পুড়িয়ে ধ্বংস করে। যেমন, ব্যারেন দ্বীপে অগ্ন্যুৎপাতে সন্নিহিত বনভূমি নষ্ট হয়।
জলবায়ু-সংক্রান্ত আকস্মিক দুর্ঘটনা: সাইক্লোন, টর্নেডো ইত্যাদি ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ ও শৈত্যপ্রবাহ বনভূমির ব্যাপক বিনাশ ঘটায়। যেমন – ১৯৯৯-এর সুপার সাইক্লোনে ওড়িশার নন্দন কাননের প্রভূত ক্ষতি হয়।
(খ) আর্থ-সামাজিক কারণ:
মানুষের বিবিধ আর্থ-সামাজিক কার্যাবলি অরণ্য বিনাশের সর্বপ্রধান কারণ।
কৃষিজমির প্রসার: গোটা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যশস্যের চাহিদা পূরণে বনভূমি ও তৃণভূমিকে পরিষ্কার করে কৃষিক্ষেত্র গড়ে তোলা হচ্ছে বছরে ২৫ লক্ষ হেক্টর হারে। নাতিশীতোন্ত তৃণভূমিতে ব্যাপক কৃষি, ভূমধ্যসাগরীয় বনভূমিতে উদ্যান কৃষ্টি, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বৃষ্টি অরণ্যে নিবিড় কৃষির জন্য অরণ্য দাংস করে কৃষিজমি তৈরি হচ্ছে অতি দ্রুতহারে।
স্থানান্তর কৃষি পদ্ধতি: দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে উপজাতি সম্প্রদায় অরণ্য কেটে ও পুড়িয়ে কৃষিজমি তৈরি করে কয়েক বছর চাষের পর মাটির উর্বরতা হ্রাস পেলে অন্যত্র একইভাবে আদিম প্রথায় চাষ তোয় করে। উত্তর পূর্ব ভারতে এ পর্যন্ত ৪৩.৫ লক্ষ হেক্টর বনভূমি স্থানান্তর কৃষির (ঝুম চাষ) জন্য ফরাস হয়েছে। পৃথিবীর ২০% জমিতে ৫%। জনসংখ্যা এই কৃষি পদ্ধতিতে অরণ্য নিধন করে চলেছে।
চারণভূমির প্রসার: সমগ্র বিশ্বে জনবিস্ফোরণের ফলে খাদ্যশস্যের সঙ্গে দুধ, মাংস, চামড়াজাত পশুজ দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে পশুচারণ ক্ষেত্রের প্রসারের সঙ্গে বনভূমি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। যথা- আমেরিকা, আফ্রিকা ও ইউরোপের ভূমধ্যসাগরীয় ও নাতিশীতোয় বনভূমি।
অনিয়ন্ত্রিত পশুচারণ: ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় উন্মুক্ত ও সুগম্য বনভূমি, ছোটো ঝোপঝাড়যুক্ত তৃণভূমিতে সহন ক্ষমতার অধিক ও অনিয়ন্ত্রিত গবাদি পশুচারণের ফলে বহু গাছপালা, ঘাস, লতাপাতা ধ্বংস হয়। গাছের পুনর্জন্ম ও বৃদ্ধি ঘটে না। এজন্য সাভনা তৃণভূমি, ভারতের উত্তরাখণ্ডের আপ্পীয় তৃণভূমি আংশিকভাবে ধ্বংস হচ্ছে।
জ্বালানি: অনুন্নত ও বিকাশশীল দেশগুলির ঘরোয়া জ্বালানি কাঠের প্রয়োজনে বহু বৃক্ষ অকালে ধ্বংস হয়। ভারতীয় অরণ্য সর্বেক্ষণের সমীক্ষা অনুসারে ভারতে বছরে গ্রামে ১৩.৪০ এবং শহরে ২.৩ কোটি টন জ্বালানি কাঠ বন থেকে সংগৃহীত হয়।
অবৈজ্ঞানিক প্রথায় বনভূমি ব্যবহার: মানুষের অদূরদর্শিতার জন্য অবৈজ্ঞানিক প্রথায় গাছ তো কাটার সময় বহু অপরিণত বৃক্ষ নির্বিচারে মারা পড়ছে। কাঠের আন্তর্জাতিক চোরাকারবার বাড়ছে।
কান্ঠ শিল্প: গৃহ, আসবাবপত্র নির্মাণ, পরিবহন, কাগজ-রেয়ন, দেশলাই, প্লাইউড, ক্রীড়া সামগ্রী নির্মাণ শিল্পে কাঠের সীমাহীন চাহিদা পূরণে সরলবর্গীয় ও নাতিশীতোয় বনভূমি দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে।
খনিজ আহরণ: কয়লা, লোহা, চুনাপাথর, ম্যাঙ্গানীজ প্রভৃতি খনিজ বিশেষত উন্মুক্ত প্রথায় উত্তোলনকালে সংশ্লিষ্ট বনভূমি ধ্বংস হয়। যেমন, ছোটোনাগপুর অঞ্চলে শাল, সেগুন অরণ্যের বিনাশ।
বহুমুখী নদী পরিকল্পনা: জলসেচ, বিদ্যুৎ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বহুমুখী উদ্দেশ্যে নদীতে বাঁধ দিয়ে জলাধার নির্মাণ করলে বিস্তীর্ণ বনভূমি নষ্ট হয়। যেমন-তেহেরি বাঁধ প্রকল্প এবং নর্মদা প্রকল্প।
অরণ্য বিনাশের ফলাফল (Effects of Deforestation) :
বিশ্বব্যাপী অরণ্য হননের সুদুজানারী নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। যথা – প্রাকৃতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক প্রভাব। নিন্মে এই দুটি প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হল।
(ক) মৃত্তিকার উপর প্রভাব:
১) ভূমিক্ষয়: ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক ছাতা বনভূমি ধ্বংস হলে বৃষ্টির জলকণা উন্মুক্ত শিখিল মাটিতে সরাসরি আঘাত করে কণাগুলিকে পৃথক করে সহজেই অপসারণ করে। ফলে গাছের শিকড় জালের মতো মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে না পেরে ভূপৃষ্ঠীয় জলধারার প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে ধৌতক্ষয় ও নালিক্ষয় ঘটে।
২) মাটির উর্বরতা হ্রাস: গাছের পাতা, ডালপালা, ফুল, ফল শিকড়ের জৈবাবশেষ সঞ্চিত না হয়ে হিউমাস গঠিত হতে পারে না। মাটি ক্ষয়ের ফলে উপরিস্তরের জৈব ও খনিজ পদার্থ অপসৃত হয়ে উর্বরতা ও জলধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
৪) মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়া ব্যাহত: বন ধ্বংসে গাছের শিকড় যান্ত্রিক, রাসায়নিক ও জৈবিক আবহবিকারের মাধ্যমে মাটি সৃষ্টি করতে পারে না ও পরিণত স্তরায়ণ গঠিত হয় না, যার ফলে মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। যেমন- ভারতে ছোটোনাগপুর মালভূমির ল্যাটেরাইট মাটি।
৫) ধস: অরণ্য নিশ্চিহ্ন হলে গাছের শিকড় অতি বৃষ্টিতে মাটিকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতে পারে না। ফলে পার্বত্য অঞ্চলে ধস নামে।
(খ) পরিবেশের ওপর প্রভাব:
১) বৃষ্টিপাত হ্রাস ও খরা: বৃক্ষ ছেদনের ফলে গাছের প্রস্বেদনের মাধ্যমে জলীয় বাষ্প ত্যাগ কমে যায় এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায়। বিশ্ব জুড়ে তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। মেঘ, ঘনীভবন ও বৃষ্টিপাত প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় ও বৃষ্টির মাত্রা হ্রাস পেয়ে খরার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। যেমন- ভারতে শিবালিক পর্বত, ছোটোনাগপুর মালভমি অঞ্চল।
২) অক্সিজেন-কার্বন ডাই-অক্সাইড ভারসাম্যহীনতা: অরণ্য নিধনের ফলে গাছ খাদ্য তৈরিতে CO2, নিয়ে O2 ত্যাগ করতে পারে না। ফলে CO2 বৃদ্ধি এবং O2 হ্রাস পায়। উভয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ গ্রিনহাউস প্রভাব ও বিশ্ব উন্নায়ন ঘটে।
৪) ঝড়ঝঞ্জা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ভাঙন: বনভূমির অভাবে ঘূর্ণিবায়ু ও সুনামি উপকূলে আছড়ে পড়ে ব্যাপক জীবন ও সম্পত্তি হানি করে। সমুদ্র পাড়ের ভাঙন ঘটায়। যেমন- ২০০৪-এর সুনামি থেকে সুন্দরবন পশ্চিমবঙ্গের উপকূল অঞ্চলকে রক্ষা করেছে।
৫) পরিবেশদূষণ: বনভূমির গাছপালা নিধনের ফলে ভাসমান বস্তুকণা বা এরোসল গাছের ডালপালাতে আটকায় না, শব্দের তীব্রতা কমে না, দূষিত CO2 শোষিত হয় না। ফলে দূষণমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
৬) মরুভূমির প্রসার: গাছ কাটার ফলে বায়ু বিনা বাধায় মরুভূমির বালি পার্শ্ববর্তী উর্বর কৃষিজমিকে আবৃত করে এবং উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বৃষ্টি হ্রাসের মাধ্যমে মরুভূমির প্রসার ঘটায়। যেমন- ভারতের থর মরুভূমির পূর্বাংশে মরুভূমির প্রসার।
বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব:
১) জলচক্রে বিঘ্ন: নির্ধনীকরণের ফলে বৃষ্টি হ্রাস পাওয়ায় ভৌমজলের অভাব ঘটে।প্রস্বেদনের মাধ্যমে তা বায়ুমণ্ডলে যুক্ত হয় না। ফলে জলের চক্রাকার আবর্তন ব্যাহত হয়। প্রাণীজগতে বিরূপ প্রভাব পড়ে।
২) জীববৈচিত্র সংকট: সবুজ উদ্ভিদ, বন্য পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া প্রভৃতি জীবের স্বাভাবিক আবাসস্থল হল অরণ্য যা ধ্বংসের ফলে বিভিন্ন জীব প্রজাতি আগামী ২৫ বছরে ১৫% বিলুপ্ত হবে।
৩) প্রাকৃতিক গ্যাস চক্রে বিঘ্ন: CO2, O2, N2 এর স্বাভাবিক চক্র বিঘ্নিত হয়ে প্রাণধারণের পক্ষে অপরিহার্য গ্যাস সংকটে জীবের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব:
- বনবিনাশে মাটির গুণমান হ্রাস পাওয়ায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। খাদ্যসমস্যার সমাধান হয় না।
- বনভূমি থেকে প্রাপ্ত বাঁশ, বেত, ভঔষধি গাছ, খয়ের, মধু, মোম, লাক্ষা, গদ, রেজিন, ধূনা, ফলমূল, মশলা, ঘাস প্রভৃতি উপজাতদ্রব্য দুর্লভ হয়ে পড়ে।
- কাঠ, কাগজ প্লাইউড শিল্পের কাঁচামালের অভাবে ওই শিল্পগুলির প্রসার ও উন্নতি বিঘ্নিত হয়।
- বন বিনাশের ফলে পার্বত্য এবং গ্রামাঞ্চলের জ্বালানি কাঠ, পাতার বিশেষ সংকট দেখা দেয়।
- প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বন্যপশুপাখির টানে পর্যটকদের আগমন বন্ধ হয়ে আরণ্যক পর্যটন শিল্প মার খাবে।