দক্ষিণ ভারতে কফি উৎপাদক অঞ্চল সমূহের বর্ণনা দাও।

দক্ষিণ ভারতের চাষ | দক্ষিণ ভারতে কফি উৎপাদন বেশি হয় কেন? | দক্ষিণ ভারতে কফি উৎপাদক অঞ্চল সমূহের বর্ণনা দাও।
Photo of author
Bishal Roy

Published On:

ভারতবর্ষে কফি উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র হলো দক্ষিণ ভারত। ভারতের কফির সিংহভাগই দক্ষিণ ভারতের তিনটি রাজ্য—কর্ণাটক, কেরল এবং তামিলনাড়ুতে উৎপাদিত হয়। পাশাপাশি অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের আরাকু উপত্যকাতেও কফি উৎপাদন হয়, যদিও তা পরিমাণে তুলনামূলক কম। ভারতের প্রায় ৩.৬৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে ৩.১৪ লক্ষ টন কফি উৎপন্ন হয় (FAO, 2012), এবং উৎপাদনের নিরিখে বিশ্বে ভারতের স্থান পঞ্চম (2012)। ভারতে প্রতি হেক্টরে গড় কফি উৎপাদনের পরিমাণ ৭৫০ কিলোগ্রাম (2011)। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে দক্ষিণ ভারতের কফি শিল্প শুধু দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বৈশ্বিক কৃষি-বাজারেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

দক্ষিণ ভারতে কফি উৎপাদক অঞ্চল সমূহ

কর্ণাটক:

কর্ণাটককে যথার্থই ভারতের “কফির ভূমি” বলা হয়। একাই এই রাজ্য ভারতের মোট উৎপাদনের প্রায় ৭২ শতাংশ কফি উৎপাদন করে। প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর জমি এখানে কফি চাষের আওতায় রয়েছে এবং বছরে প্রায় ২.৩ লক্ষ টন কফি উৎপন্ন হয়। প্রধান কফি উৎপাদক জেলা হলো চিকমাগালুর, কোদাগু (কুর্গ), হাসান, মাইসোর এবং শিমোগা। এর মধ্যে কোদাগু জেলায় রাজ্যের সর্বাধিক কফি উৎপন্ন হয়। ঐতিহাসিকভাবে চিকমাগালুর অঞ্চলেই প্রথম কফির বীজ রোপিত হয়েছিল ১৭শ শতকে সুফি সাধক বাবাবুদানের উদ্যোগে। এখানকার পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০০–১৫০০ মিটার উচ্চতা, বার্ষিক ২০০০–৩০০০ মিমি বৃষ্টিপাত, এবং ছায়াচ্ছন্ন চাষপদ্ধতি কফিকে অনন্য স্বাদ ও সুবাস প্রদান করে। “মনসুনড মালাবার কফি” কর্ণাটকের বৈশ্বিক খ্যাতি অর্জনকারী একটি বিশেষ কফি প্রজাতি।

এটিও পড়ুন :  ভারতে রাগি উৎপাদন সম্বন্ধে আলোচনা করো।

কেরল:

কেরল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম কফি উৎপাদক রাজ্য, যেখানে দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ কফি উৎপাদিত হয়। প্রায় ১ লক্ষ হেক্টর জমি কফি চাষের আওতায় রয়েছে এবং উৎপাদনের পরিমাণ বছরে প্রায় ৬৪,২০০ টন। ওয়ানড়, ইদুক্কি ও পালাক্কাড জেলায় কফি চাষ সবচেয়ে বেশি হয়। বিশেষত ওয়ানড় জেলায় রাজ্যের সর্বাধিক কফি উৎপন্ন হয়। কেরলের কফি প্রধানত রোবাস্টা প্রজাতির, যা তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী স্বাদ ও গাঢ় ঘনত্বপূর্ণ হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন। এখানে ছায়া-চাষ ও মশলার সঙ্গে আন্তঃচাষ (যেমন গোলমরিচ, এলাচ, লবঙ্গ) বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিত। ফলে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় এবং কৃষকের আয় বাড়ে। উল্লেখযোগ্যভাবে, “ওয়ানড় কফি” ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) ট্যাগপ্রাপ্ত, যা কেরলের কফিকে বৈশ্বিক বাজারে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে।

আরও পড়ুন: চা চাষের অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশ

তামিলনাড়ু:

তামিলনাড়ু ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম কফি উৎপাদক রাজ্য, যার অংশ প্রায় ৬ শতাংশ। প্রায় ৫০,০০০ হেক্টর জমি কফি চাষে ব্যবহৃত হয় এবং উৎপাদনের পরিমাণ বছরে প্রায় ১৭,৩৭০ টন। প্রধান কফি উৎপাদক অঞ্চল হলো নীলগিরি, সালেম, কোয়েম্বাটোর, মাদুরাই ও তিরুনেলভেলি। নীলগিরি ও শেইভারয় পাহাড়ের কফি বিশেষ সুবাসময় ও মৃদু স্বাদের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে জনপ্রিয়। এখানে মূলত অ্যারাবিকা কফির আধিক্য রয়েছে। তামিলনাড়ুর কফি উৎপাদন ক্ষুদ্র কৃষকদের হাতে কেন্দ্রীভূত, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে চাষ করছেন। তাছাড়া, একই অঞ্চলে কফি ও চা উভয়ই চাষ করা হয়, যা কৃষি বৈচিত্র্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।

অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশ:

অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম জেলার আরাকু উপত্যকা কফি উৎপাদনে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানকার উৎপাদন পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম হলেও, বছরে প্রায় ৬,২৩০ টন কফি উৎপন্ন হয়। আদিবাসী কৃষকেরা জৈব পদ্ধতিতে কফি চাষ করেন, যা আন্তর্জাতিক বাজারে “আরাকু কফি” নামে বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে। আরাকু কফি বর্তমানে শুধু ভারতেই নয়, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপানের মতো দেশেও রপ্তানি করা হয়। এই অঞ্চলের জৈব কফি উৎপাদন পরিবেশবান্ধব কৃষির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আরও পড়ুন: ভারতে কফি চাষের অনুকূল পরিবেশ সম্বন্ধে আলোচনা করো।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব

দক্ষিণ ভারতের কফি উৎপাদন স্থানীয় সমাজ ও অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, বিশেষত নারীরা শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ গঠন করে। কফি বাগানগুলো গ্রামীণ অঞ্চলে কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান উৎস। কর্ণাটক ও কেরলে কফি শিল্পের মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নতি, শিক্ষার প্রসার এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। কুর্গ ও চিকমাগালুরের কফি-বাগান আজ বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও কফি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভারতের কফির একটি বড় অংশ ইউরোপ ও আমেরিকায় রপ্তানি হয়। এইভাবে কফি শিল্প দক্ষিণ ভারতের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সমৃদ্ধ করছে।

এটিও পড়ুন :  চা চাষের অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশ | চা উৎপাদনের অনুকূল অবস্থাগুলি আলোচনা করো।

উপসংহার

সার্বিকভাবে বলা যায়, দক্ষিণ ভারতের কফি উৎপাদন অঞ্চলসমূহ ভারতের কৃষি ও অর্থনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কর্ণাটকের বিশাল উৎপাদন, কেরলের রোবাস্টা চাষের বৈশিষ্ট্য, তামিলনাড়ুর সুবাসময় অ্যারাবিকা, এবং আরাকুর জৈব কফি মিলে ভারতীয় কফিকে বৈশ্বিক বাজারে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান এনে দিয়েছে। শুধু উৎপাদনের পরিসংখ্যানেই নয়, ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, কৃষির বৈচিত্র্য, সামাজিক প্রভাব ও আন্তর্জাতিক মর্যাদার কারণেও দক্ষিণ ভারতের কফি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ভবিষ্যতে প্রযুক্তি, জৈবচাষ ও বৈশ্বিক বিপণনের বিস্তারের মাধ্যমে দক্ষিণ ভারতের কফি শিল্প আরও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে।

Leave a Comment