সম্পদের কার্যকারিতা তত্ত্ব (Functional Theory of Resources): মিচেল, মার্শাল, বাওম্যান প্রমুখ সম্পদে কার্যকারিতা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করলেও জার্মান অর্থনীতিবিদ ই. ডব্লু, জিমারম্যান (১৯৫১খ্রি.) সম্পদের কার্যকারিতা তত্ত্বের জনক ও প্রবর্তক। তাঁ মতে, বস্তুর কল্যাণময় উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট স্থান ও সময়ে ব্যক্তিগত বা সামাজিক প্রয়োজন মেটাবার বৈশিষ্ট্যকে কার্যকারিতা বলে এবং নির্দি কার্যকারিতাযুক্ত বস্তুই হল সম্পদ। মানুষ প্রাকৃতিক, মানবিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ অতিক্রম করে প্রকৃতির অব্যবহৃত নিরপেক্ষ উপাদাননে ব্যক্তিগত বা সামাজিক চাহিদা পূরণ, অভাবমোচন, মঙ্গল বা হিতসাধনের কাজে ব্যবহার করে সম্পদে পরিণত করে। তাই কোনো বস্তু ন পদার্থকে সম্পদ রূপে গণ্য হতে গেলে অবশ্যই তার উপযোগিতা বা অভাব পূরণের ক্ষমতা থাকবে যা চাহিদা মেটাতে ব্যবহৃত হয় বা সক্ষম হয়
উদাহরণ: ভূগর্ভস্থিত খনিজ দ্রব্য সম্পদ নয়। তা নিরপেক্ষ উপাদানরূপে প্রকৃতিতে থাকে। মানুষ তা উত্তোলন করে মানব সমাজে ব্যবহারোপযোগী করলে তার কার্যকারিতা প্রমাণিত হয় এবং খনিজ সম্পদে পরিণত হয়।
মূল বিষয়বস্তু:
(১) কোনো বস্তু বা পদার্থ বা মানবীয় গুণের মঙ্গলময় অভাব মোচন কার্যকরী ক্ষমতা ও উপযোগিতা হল সম্পদ
(২) মানবীয় গুণ বা সংস্কৃতির (যথা-শিক্ষা, জ্ঞান, বুদ্ধি) কার্যকরী ক্ষমতা থাকলে তা সম্পদে পরিণত হয় যা আবার কার্যকারিতা বাড়ায়
(৩) মানবীয় গুণাবলি, সমাজের বহুমুখী চাহিদা, আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য, প্রশাসনিক দক্ষতা ও কর্ম ক্ষমতা সম্পদের কার্যকারিতাে পরিবর্তনশীল ও গতিশীল করে। যেমন-পূর্বে একমাত্র জ্বালানি রূপে পেট্রলিয়ামের ব্যবহার বর্তমানে ১০০০ রকমের ব্যবহারে পর্যবসিত হয়েছে
(৪) কার্যকারিতার জন্য সম্পদের পরিধি ব্যাপক হয়। যেমন-খনিজ তেল থেকে তৈরি হয় কীটনাশক, সার, প্লাস্টিক, প্রসাধনী দ্রব্য
(৫) কার্যকারিতার জন্য সম্পদ গতিশীল হয়। যেমন-কেরল উপকূলে মোনাজাইট বালি থেকে আণবিক শক্তি উৎপাদন।
(৬) কার্যকারিতা না থাকলে কোনো বস্তু বা অবস্তু উপাদান সম্পদ হয় না। যেমন –
- বস্তু + কার্যকারিতা = সম্পদ (যথা-নদীর জল, উদ্ভিদ)
- বস্তু – কার্যকারিতা = সম্পদ নয় (যথা-অনুৎপাদক জমি)
- অবস্তু + কার্যকারিতা = সম্পদ (যথা-শিক্ষা, কর্মদক্ষতা)
- অবস্তু -কার্যকারিতা = সম্পদ নয় (যথা-কুসংস্কার, যুদ্ধ)
- সম্পদ + কার্যকারিতা = সম্পদ (যথা-প্লাস্টিক, সার)
- সম্পদ – কার্যকারিতা= সম্পদ নয় (যথা-ভূমিক্ষয়, বন্যা)
সম্পদের কার্যকারিতা বিবর্তনের চারটি পর্যায়:
(১) প্রথম পর্যায়ে মানব সভ্যতা আদিকালে অধিকাংশ পদার্থই ছিল নিরপেক্ষ উপাদান এবং তাদের কার্যকারিতা প্রায় সর্বত্র একই ছিল। মানুষের প্রচেষ্টা ছাড়াই প্রকৃতির অফুরন্ত পুনর্ভব সম্পদ অর্জন ঘটে।

(২) দ্বিতীয় পর্যায়ে মানুষ কায়িক পরিশ্রম দ্বারা সম্পদ সংগ্রহ করে। প্রথম পর্বের চেয়ে সম্পদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
(৩) তৃতীয় পর্যায়ে মানুষ কারিগরি দক্ষতা। কতা ও প্রযুক্তি দ্বারা সর্বাধিক সম্পদ উৎপাদন করে। এই পর্বে কার্যকারিতা সর্বোচ্চ হয়। প্রকৃতির অধিকাংশ নিরপেক্ষ সামগ্রী সম্পদে প পরিণত হয়। মানুষ তাঁর চাহিদামতো সম্পদ থেকে নতুন সম্পদ তৈরি করে।

(৪) চতুর্থ পর্যায়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সঞ্চিত সম্পদ দারুণভাবে হ্রাস পায়। ব্যাপক পরিবেশদূষণ শদূষণ ঘটে। প্রযুক্তির উন্নতি সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়। প্রচলিত সম্পদের বিকল্প দ্রব্য উদ্ভাবন ও ব্যবহারে মানুষ সচেষ্ট হয়। এই সময় মানব উন্নয়ন স্থিতিশীল হয়।
সম্পদের কার্যকারিতার নিয়ন্ত্রক:
সম্পদের কার্যকারিতা চারটি বিষয় দ্বারা নির্ধারিত হয়। যথা – চাহিদা, প্রযুক্তি ও জ্ঞান, সময় এবং স্থান। এই চারটি নিয়ন্ত্রক সম্পর্কে নিন্মে আলোচনা করা হল-
(১) চাহিদা: মানুষের মৌলিক ভোগবিলাসের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে নিত্যনতুন সম্পদের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে সম্পদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় বা বহুমুখী হয়।
(২) প্রযুক্তি ও জ্ঞান: বিজ্ঞান মানুষের জ্ঞান ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং প্রযুক্তি উন্নতির মাধ্যমে নিরপেক্ষ উপাদানকে সম্পদে পরিণত করে বা কম পরিমাণ প্রাকৃতিক উপাদান থেকে অধিক কার্যকারিতাযুক্ত সম্পদ সৃষ্টি হয়। যথা- সেলভা অরণ্যের বুনো রবার গাছ থেকে ভলকানাইজেশন পদ্ধিতে একটি অমূল্য সম্পদ-প্রাকৃতিক রবার তৈরি, উন্নত কৃষি প্রযুক্তি দ্বারা ভারতে সবুজ বিপ্লব ঘটিয়ে উচ্চমানের গম উৎপাদন।
(৩) সময়: সময়ের সঙ্গে মানুষের শিক্ষা, জ্ঞান, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, মূল্যায়ন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে সম্পদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, বহুমুখী হল
(৪) স্থান: সম্পদ প্রাপ্তি স্থানের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের ওপর কার্যকারিতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। কোনো স্থানে নিরপেক্ষ উপাদান বা বাধা, অন্য স্থানে তা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। যেমন-খরস্রোতা নদী জাপানে জলবিদ্যুৎ সম্পদ হলেও মধ্য আফ্রিকায় তা নয়।