ক্ষয়চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নদীর দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপ:
পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ একটি গতিশীল ব্যবস্থা, যা বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্রমাগত রূপান্তরিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হলো নদী। একটি নদী যখন তার প্রবাহপথ ধরে বয়ে চলে, তখন তা পরিবহন, ক্ষয় এবং সঞ্চয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আশেপাশের ভূমিকে গঠন ও পুনর্গঠন করে। এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ সময় ধরে চলে এবং একে বলা হয় ক্ষয়চক্র। ক্ষয়চক্র সাধারণত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত—প্রাথমিক (প্রারম্ভিক), মধ্যবর্তী ও পরিণত পর্যায়—এবং প্রতিটি পর্যায়েই নদী তার শক্তি ও কার্যকারিতার ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্রদর্শন করে। প্রতিটি পর্যায়ে নদী ভিন্ন ধরনের ভূমিরূপ সৃষ্টি করে, যেমন খাত, জলপ্রপাত, প্লাবনভূমি, ইত্যাদি।
(১) যৌবন পর্যায়ে সৃষ্ট ভূমিরূপ
গিরিখাত ও ক্যানিয়ন: স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের যৌবন পর্যায়ে নদীর ঢাল বেশি থাকে। তাই নদী দূরন্ত গতিতে নিম্নস্কয় করেএগিয়ে চলে। ঢলে নদী-উপত্যকা সংকীর্ণ ও গভীর হয়। উপত্যকাটি’ আকৃতির রূপ নেয়। আবহবিকার, ধম ও জলপ্রবাহের ফলে এই’।’ আকৃতির উপভাকার দুই পাড় বিস্তৃত হয়ে ” আকৃতির উপত্যকা গঠন করে।নদী উপত্যকা ভীষণ গভীর ও সংকীর্ণ হয়ে গিরিখাত সৃষ্টি করে। এই পর্যায়ে নদীর ঢাল অত্যন্ত বেশি থাকে বলে এর পার্শ্বক্ষয় অপেক্ষা নিম্নচ্চয় বেশি হয়। ক্রমাগত নিম্নজয়ের ফলে এই অঞ্চলে খাড়াপাড়যুক্ত গভীর গিরিখাত সৃষ্টি হয়। শুষ্ক অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী অত্যন্ত গভীর ও সংকীর্ণ গিরিখাত সৃষ্টি করে, একে ক্যানিয়ন বলে। শুষ্ক অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের অভাবে পার্শ্বক্ষয় বিশেষহয় না, কিন্তু নিম্নক্ষয় হয় সর্বাধিক। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের শুষ্ক অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কলোরাডো নদী পৃথিবীর গভীরতম ক্যানিয়ন প্ল্যান্ড ক্যানিয়ন সৃষ্টি করেছে।
শৃঙ্খলিত বা আবদ্ধ শৈলশিরা: পার্বত্য অঙ্গলে শৈলশিরাগুলি উপত্যকার দিকে নেমে এলে নদী শৈলশিরার বাধা এড়িয়ে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। তাই মনে হয় শৈলশিরাগুলি শৃঙ্খলিত বা আবদ্ধ অবস্থায় আছে। একে আবদ্ধ শৈলশিরা বলে। দার্জিলিং হিমালয়ে বহু শৃঙ্খলিত শৈলশিরা দেখা যায়।
জলপ্রপাত: নদীর গতিপথে জলতলের আকস্মিক উল্লম্ব বা প্রায় উল্লম্ব পতনকে জলপ্রপাত বলে। এই পর্যায়ে নদী-ঢালের পরিবর্তনের ফলে প্রবল জলরাশি খাড়া ঢালের নীচে নেমে এলে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ আমেরিকার সাল্টো অ্যাজেন (980 মি) পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাত। প্রবল জলধারা বা নদী পরপর কয়েকটি জলপ্রপাত সৃষ্টি করে নীচের দিকে নেমে এলে তাকে শ্রেণিবদ্ধ জলপ্রপাত বা ক্যাটার্যাক্ট বলে। একাধিক ছোটো ছাটোজলপ্রপাত সৃষ্টি করে নদী প্রবাহিত হলে যে সারিবদ্ধ ক্ষুদ্রাকার জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়, সেগুলিকে ক্যাসকেড বা নিপর বলে। নদীর স্বাভাবিক গতির চেয়ে সামান্য তীরগতিতে সিঁড়ির মতো ঘোটো ছোটো ধাপে নীচের দিকে নেমে এলে তাকে র্যাপিড বা খরস্রোড়বলে।
মন্থরূপ বা পটহোল: নদীর গতিপথে কোমল শিলা অবস্থান করনে নদীবাহিত কঠিন শিলাখণ্ডের আঘাতে ঐ কোমল শিলায় গর্তের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন আকৃতির শিলাখণ্ডসহ জল ওই গর্তে আবর্তিত হয়ে গভীর গর্তের সৃষ্টি করে। নদীগর্ভে এইরূণ গর্ভবিশিষ্ট ভূমিরূণকে মহুকূপ বা পটহোল বলে। দক্ষিণ আফ্রিকার স্লাইড নদী উপত্যকার তলদেশে অনেক মন্থকূপ দেখা যায়।
(2) পরিণত পর্যায়ে সৃষ্ট ভূমিরূপ
পলল ব্যজনী ও পলল শঙ্কু: এই পর্যায়ে নদীর ঢাল ও গতিবেগ কমে যায় বলে নদীবাহিত শিলাখণ্ড, নুড়ি, বালি, কর্দম প্রভৃতি পাদদেশেসঙ্গিত হয়ে পলল ব্যজনী ও পলল শঙ্কু গঠন করে। পলল শম্ভু ও পলল বাজনী অর্ধবৃত্তকার হয়। এদের নীচের অংশ বেশ চওড়া কিন্তু ওপরের অংশ ক্রমশ সরু হয়ে শম্ভুর আকার ধারণ করে। পলল ব্যজনী সাধারণত অতি সুগ্ধ পদার্থ দ্বারা গঠিত হয়। তাই এর বেধ কম, কিন্তু পলল শঙ্কু বড়ো বড়ো শিলাখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর ও বালুকণা দ্বারা গঠিত হয়।
প্লাবনভূমি ও স্বাভাবিক বাঁধ: এই পর্যায়ে প্লাবনভূমি উপত্যকার সিংহভাগ জুড়ে অবস্থান করে। নদীর ঢাল কমে যাওয়ায় নদীর বহন ক্ষমতা কমে যায়। ভাই জলের সঙ্গে বাহিত পদার্থসমূহ সঙ্গিত হয়ে প্লাবনভূমি সৃষ্টি করে। আবার, নদীর দুকূলে বাহিত পদার্থসমূহ সঙ্গিত হয়ে বাঁধের আকৃতির যে ভূমিরূণ গঠন করে তাকে স্বাভাবিক বাঁধ বলে।
নদীচর বা নদীদ্বীপ: নদীর চাল কমে যাওয়ায় নদীর বহন ক্ষমতা কমে যায়। ফলে, নদীবাহিত পদার্থসমূহ নদীগর্ভে ক্রমাগত সক্ষিত হয়ে চর বা চড়ার সৃষ্টি হয়। নদীর চড়ায় বারংবার পলি সক্ষয়েরফলে চড়াগুলি উঁচু হয়ে দ্বীপে পরিণত হয়। নদীগর্ভে অসংখ্য চর বা দ্বীপ থাকলে নদী এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। অসমের ব্রত্মপুত্র নদীর গতিপথে গড়ে ওঠা মাজুলি দ্বীপটি বিশ্বের বৃহত্তম নদীদ্বীপ।
(3) বার্ধক্য পর্যায়ে সৃষ্ট ভূমিরূপ
প্লাবনভূমি ও স্বাভাবিক বাঁধ: এই পর্যায়ে নদীর ঢাল ভীষণভাবে কমে যায়। ফলে নদীর বহন ক্ষমতাও কমে যায়। তাই নদীবাহিত পদার্থসমূহ দীর্ঘদিন ধরে নদীখাতে সজিত হয়ে নদীখাতকে ভরাট করে তোলে। নদীর দুকূল বরাবর বালি সঞ্চিত হয়ে বাঁধের আকারে যে দীর্ঘ ভূমিরূণ গড়ে ওঠে তাকে স্বাভাবিক বাঁধ বলে। বন্যার সময় নদীতে জলের পরিমাণ বেড়ে গেলে অগভীর নদীখাত দিযে ওই জল প্রবাহিত হতে পারে না। অতিরিক্ত জল দু-কূল ধ্যদিয়ে পার্শ্ববর্তী উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে। অলের সঙ্গে বাহিত পদার্থ সঞ্চিত হয়ে প্লাবনভূমি গড়ে ওঠে।
নদীচর ও নদীদ্বীপ: নদীবাহিত পদার্থসমূহ নদীখাতে ক্রমাগত সঙ্গিত হয়ে চর বা চড়ার সৃষ্টি হয়। চড়াগুলিতে বারবার পলি সঙ্গিত হয়ে উঁচু হয়ে দ্বীপে পরিণত হয়।
নদীবাক: নদী চলার পথে বাধা পেলে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। জলস্রোত নদীবাঁকের যে অংশে আঘাত করে সেখানে স্কয় হয় এবং বিপরীত অংশে পলি সঞ্চিত হয়ে বিন্দুবার সৃষ্টি করে। ধারাবাহিকভাবে নদীতে ক্ষয় ও সক্ষয়ের ফলে নদীতে অসংখা নদীবাক সৃষ্টি হয়।
অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ: নদী খুব এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হলে পরপর দুটি নদীবাঁকের মধ্যবর্তী অংশ সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে নদীবাক সংযুক্ত হলে নদী বাঁকা পথে ছেড়ে সোজাপথে চলে। স্কুলে পরিত্যক্ত নদীবকটি হ্রদের আকার ধারণ করে। একে অশ্বক্ষুরাকৃতির হ্রদ বলে।
পেনিপ্লেন ও মোনাড়নক: ক্ষয়চক্রের অন্তিম পর্যায়ে নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ক্ষয়ের শেষ সীমায় বা তার কাছাকাছি অবস্থান করলে বৈচিত্রাহীন সমপ্রায় ভূমি সৃষ্টি হয়। একে পেনিয়েন বলে। এই সময় ভূমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু ক্ষয়প্রতিরোধী শিলায় গঠিত স্বল্প উঁচু টিলা বা পাহাড় দেখা যায়। এই পাহাড় বা টিলাকে মোনাড়নক বলে।