আজকে তোমাদের সাথে একটি প্রবন্ধ রচনা শেয়ার করলাম। যেটি তোমাদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে যথেষ্ট ভাবে সাহায্য করবে। র্যাগিং ও ছাত্রসমাজ এর উপর একটি প্রবন্ধ রচনা শেয়ার করলাম। অতএব আর বেশি অপেক্ষা না করে এখনেই প্রবন্ধ রচনাটি দেখে নাও।
র্যাগিং ও ছাত্রসমাজ
মানুষের মধ্যে যে অন্ধ-আদিম প্রবৃত্তিগুলি রয়েছে, তারই অন্যতম হল তার অপরাধপ্রবণতা। এর দ্বারা তাড়িত হয়ে সে প্রায়শই এমন হিংস্র ও বর্বর হয়ে ওঠে, যা সভ্যতাদর্পী আধুনিকতার সামনে আমাদেরকে এক বড়ো প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা লজ্জায়, সংকোচে নিজেদের মনুষ্যধর্ম সম্পর্কেই দ্বিধা-জড়িত সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়ি। এমনই একটি অমানবিকতার ক্ষেত্র হল র্যাগিং, যা বর্তমানে শিক্ষা- সাম্রাজ্যের একাংশে দগদগে ঘায়ের মতো একটি বীভৎস ক্ষত সৃষ্টি করেছে।
র্যাগিং নামক সামাজিক এই অপরাধটি সাধারণত সংঘটিত হয় ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসগুলিতে। নবীন ছাত্রছাত্রীদেরকে শারীরিক ও মানসিক উপায়ে বিবিধ প্রকারে হেনস্থা করে ‘প্রবীন’ দাদা-দিদিরা এক ধরনের আদিম উল্লাস উপভোগ করে থাকে এবং অনেক সময়েই তা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, র্যাগিংয়ের শিকার যারা তাদের জীবনে বহন করে আনে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণাম। তখন এই ‘প্রথা’-টি কেবলমাত্র আর ‘মজা’ থাকে না, ছাত্রছাত্রীদের জীবনে তা হয়ে ওঠে নিদারুণ অভিশাপ। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা, শীতের রাতে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় খোলা আকাশের নীচে দীর্ঘ সময় দাঁড় করিয়ে রাখা, ছাদের পাঁচিল দিয়ে হাঁটানো, কড়া মাদকদ্রব্য জোর করে খাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি বহুতর উপায়ে পীড়ন চালানো হয়। তার সঙ্গে আবার নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত না হওয়ার কারণ দেখিয়ে চলতে থাকে চড়চাপড় ও গালিগালাজ।
কেন এই র্যাগিং?-এর কারণস্বরূপ একাধিক যুক্তির কথা বলা হয়ে থাকে। র্যাগিংয়ের পক্ষে এবং বিপক্ষে দুই প্রকার যুক্তিই উত্থাপিত হতে দেখা যায়। যাঁরা সমর্থক, তাঁরা বলেন যে, এর ফলে সদ্য আগত নবীন ছাত্রছাত্রীরা যেমন সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়, তেমনই পূর্ববর্তী বছরের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নবাগতদের যোগ নাকি ঘনিষ্ঠ হয়। কিন্তু সুস্থ মানসিকতার বিচারে, এই বিশেষ কুরুচিকর প্রথাটিকে একটি বিকৃত উল্লাসের জঘন্য প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। প্রভুত্ব প্রদর্শনের তাগিদে যারা দুর্বল তাদের প্রতি সবলের পীড়নের প্রবণতা র্যাগিংয়ের মূলে কাজ করে থাকে। র্যাগিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হল প্রাধান্য স্থাপন।
‘র্যাগিং’ বিষয়টি প্রধানত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সঙ্গে জড়িত, তবে সাম্প্রতিক কালে শুধুমাত্র আর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সঙ্গেই এই জঘন্য অপরাধমূলক কাজটি সীমাবদ্ধ নয়, সাধারণ কলেজেও এখন এই র্যাগিং ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১০-এর ‘The Times of India’-য় প্রকাশিত একটি সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে দেখা যায়, সর্বাধিক র্যাগিং হয় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, দ্বিতীয় স্থানে আছে সাধারণ কলেজগুলি, অর্থাৎ যেখানে বিএ, বিকম, বিএসসি পড়ানো হয় এবং সর্বশেষ স্থানে আছে মেডিকেল কলেজগুলি। র্যাগিং দিনে দিনে ছাত্রসমাজের কাছে একটা ত্রাস হয়ে উঠছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সাধারণ কলেজের ছাত্রছাত্রীরা র্যাগিং কী, কীভাবে হয় তা জানত না, কিন্তু বর্তমানে তারা এই প্রক্রিয়ার কবলে পড়ে নিদারুণভাবে আতঙ্কগ্রস্ত। বর্তমানে কিছু মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রথমেই ‘নোটারি পাবলিক’ দ্বারা র্যাগিং না করার সম্মতিপত্র প্রদান করা হয়। যার ফলে সেই সকল কলেজে র্যাগিংয়ের মাত্রা অনেক কম দেখা যাচ্ছে। এই বর্বরতা বন্ধ করতে হলে এই ব্যবস্থা সকল কলেজেই নেওয়া উচিত।
র্যাগিংয়ের ফল মারাত্মক হয়ে দেখা দেয় ছাত্রছাত্রীদের জীবনে, যার সংবাদ প্রায়ই আমাদের নজরে আসে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্রে। শারীরিক ও মানসিক আঘাতের তীব্রতা সম্ভাবনাময় অনেক ছাত্রছাত্রীদের জীবনকেই অসময়ে নষ্ট করে দিচ্ছে, কেউ কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে, অনেকে র্যাগিংয়ের ভয়াবহতার আগাম কথা শুনে কোনো কোনো বিশেষ কলেজে সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সাহস করে ভরতি হতে পারছে না। এমনকি অনেকে আবার অত্যাচারের মাত্রাতিরিক্ততায় ও স্বপ্নভঙ্গের হতাশায় শেষ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। অচিরেই বর্বর এই প্রথার অবসান হওয়া দরকার-শিক্ষার স্বার্থে, সমাজের কল্যাণে। এর জন্য বড়ো আকারে জনমত গড়ে তুলতে হবে। র্যাগিং নামক অপরাধ নিরসনের দৃঢ় মনোভাব নিয়ে সংশ্লিষ্ট কলেজ কর্তৃপক্ষকে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা অপরাধী, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে ভবিষ্যতে আর যাতে কেউ এই জাতীয় কুকর্মে রত না হয় তার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে তোলার দায়িত্বও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর।
আরও পড়ুন: বাংলার উৎসব প্রবন্ধ রচনা
র্যাগিং নামক জঘন্য প্রথার অবসান হওয়া জরুরি। প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই শিক্ষার্থীদের নীতি-আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠদানের সময় কমিয়ে বিকেলে খেলাধুলা, গানবাজনা, শিল্পকলার কাজ করার দিকে শিক্ষার্থীদের মনোযোগী করে তুলতে হবে। কলেজে ছাত্রাবাসে কড়া নজরদারির পাশাপাশি একই রুমে একই ক্লাসের বা বিষয়ের (subject) ছাত্রছাত্রী রাখা বন্ধ করতে হবে। র্যাগিং প্রতিরোধে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। এ ব্যাপারে অভিভাবক-অভিভাবিকাদের আরও বেশি সচেতন হওয়া দরকার। র্যাগিং বন্ধ করতে সত্যিকার শিক্ষা, মানবিকতার শিক্ষা, আর নিয়মশৃঙ্খলাকে যথাযথভাবে পরিচালনা করার জন্য কর্তৃপক্ষের কঠোর শাসন ও অনুশাসন প্রয়োজন।