ভারতের গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচি: SGSY | Rural Development Programmes in India – SGSY

ভারতের গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচি: SGSY | Rural Development Programmes in India - SGSY
Photo of author
Bishal Roy

Published On:

ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যার একটি বিশাল জনগোষ্ঠী গ্রামে বাস করে। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ছাড়া দেশের সার্বিক অগ্রগতি অসম্ভব। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত সরকার গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং আত্মনির্ভরতার লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে চালু হওয়া স্বর্ণজয়ন্তী গ্রামীণ স্ব-রোজগার যোজনা (SGSY) ছিল একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক কর্মসূচি। এই প্রকল্পটি মূলত গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাস এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে গৃহীত হয়। এই প্রবন্ধে SGSY কর্মসূচির মূল বৈশিষ্ট্য, লক্ষ্য, বাস্তবায়ন পদ্ধতি, প্রভাব এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হবে।

SGSY-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

SGSY-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বনিযুক্তির মাধ্যমে দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলে আনা। এই প্রকল্পের দর্শন ছিল “গ্রুপ ও উদ্যোগ”– অর্থাৎ স্ব-সহায়তা গোষ্ঠী (Self Help Groups – SHGs) গঠন করে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্ব-উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করা। কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্নিহিত সামর্থ্যকে জাগিয়ে তুলে, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে টেকসই জীবিকা গড়ে তুলতে সহায়তা করা। এই কর্মসূচি দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচলিত ধারণাকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়, যেখানে অনুদান বা ভর্তুকির পরিবর্তে ক্ষমতায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হয়।

স্ব-সহায়তা গোষ্ঠীর (SHG) ভূমিকা ও গঠন

SGSY-র মূল ভিত্তি ছিল স্ব-সহায়তা গোষ্ঠী বা SHG। এই গোষ্ঠীগুলি সাধারণত ১০–২০ জন দরিদ্র নারী বা পুরুষ নিয়ে গঠিত হয়, যারা মিলিতভাবে ক্ষুদ্র সঞ্চয় করে এবং ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে আর্থিক কর্মকাণ্ড শুরু করে। এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক উদ্যোগ গড়ে ওঠে। SGSY গোষ্ঠীগুলিকে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংকের সাথে যুক্ত করে দেয় এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে। নারী SHG-গুলির ক্ষেত্রে এই কর্মসূচি বিশেষ গুরুত্ব পায়, কারণ এটি নারী ক্ষমতায়নের এক কার্যকরী হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন, অন্ধ্রপ্রদেশের ‘দ্বারাকা’ ও তামিলনাড়ুর ‘পূমালা’ গোষ্ঠীগুলি SGSY-এর আওতায় সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

এটিও পড়ুন :  গ্রামীণ উন্নয়নে অ-কৃষি খাতের ধারণা ও গুরুত্ব | Concept and importance of non-farm sector in rural development

প্রশিক্ষণ, ঋণ ও ভর্তুকি:

SGSY কেবল ঋণপ্রদান নয়, বরং একটি সমন্বিত সহায়তা কাঠামো গড়ে তোলে যেখানে প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং বাজার সংযোগের দিকেও জোর দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে SHG সদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়। এরপর গোষ্ঠীভিত্তিক কার্যক্রম চালু করতে ব্যাংকের মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা হয়, যার উপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভর্তুকি (সাবসিডি) সরকার থেকে প্রদান করা হত। এই ভর্তুকি গ্রুপের সঞ্চয় এবং ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতো। অনেক ক্ষেত্রেই পশুপালন, মৎস্য চাষ, ক্ষুদ্র শিল্প, হস্তশিল্প, সেলাই, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি উদ্যোগগুলি SGSY-এর মাধ্যমে সফলভাবে গড়ে ওঠে।

SGSY বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

SGSY কর্মসূচিটি তার সুফল সত্ত্বেও বিভিন্ন বাস্তবায়নজনিত সমস্যার সম্মুখীন হয়। অনেক স্থানে গোষ্ঠীগুলি শুধু প্রকল্পের সুবিধা নেওয়ার জন্য কাগজে-কলমে গঠিত হলেও, বাস্তবে সেগুলি সক্রিয় ছিল না। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, ব্যাংক ও গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে অবিশ্বাস, বাজারসংযোগের দুর্বলতা এবং প্রশাসনিক জটিলতা SGSY-এর কার্যকারিতা হ্রাস করে। এছাড়া, ভর্তুকিভিত্তিক পদ্ধতি অনেক সময় গোষ্ঠীগুলিকে প্রকৃত আত্মনির্ভরতায় পৌঁছাতে সাহায্য না করে কেবলমাত্র ক্ষণস্থায়ী সুবিধায় সীমাবদ্ধ করে তোলে। একাধিক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, প্রকল্পের লক্ষ্য অনুযায়ী সমস্ত দরিদ্র পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

SGSY থেকে NRLM: রূপান্তর ও উন্নয়ন

SGSY-এর সীমাবদ্ধতা ও সাফল্য বিবেচনা করে ২০১১ সালে এই কর্মসূচিকে জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশন (NRLM) নামে রূপান্তর করা হয়। NRLM (যা বর্তমানে ‘দীনদয়াল অন্ত্যোদয় যোজনা’ নামে পরিচিত) SGSY-এর মূল দর্শনকে বজায় রেখেই আরও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও বাজারভিত্তিক সংযুক্তিকে গুরুত্ব দেয়। SGSY-এর অভিজ্ঞতা NRLM-কে একটি উন্নত ও স্থিতিশীল কর্মসূচিতে রূপান্তর করতে সাহায্য করে, যেখানে দক্ষতা উন্নয়ন, ডিজিটাল অর্থনীতি, এবং আত্মনির্ভরতা আরও বাস্তবভাবে কার্যকর হয়। NRLM-এর মাধ্যমে বহু SHG নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন, যা SGSY-এর বীজ থেকে সৃষ্ট এক গৌরবময় বিকাশ।

এটিও পড়ুন :  গ্রামোন্নয়নের পন্থা (Approaches to Rural Development)

উপসংহার: SGSY ভারতের গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মনির্ভরতার পথে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র জনগণকে শুধুমাত্র ভাতার উপর নির্ভর না রেখে, তাদের স্বকীয় উদ্যোগ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা গড়ে তোলার ক্ষমতা প্রদান করা। যদিও প্রকল্পটি অনেক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়, তবুও এটি ভারতের গ্রামীণ উন্নয়নের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। SGSY থেকে NRLM-এ উত্তরণ এক ইতিবাচক রূপান্তর, যা আজও গ্রামীণ নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা ও সমাজে সম্মান অর্জনের পথ প্রশস্ত করছে। সুতরাং, SGSY শুধুমাত্র একটি প্রকল্প নয়, বরং এক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা, যার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী ও গৌরবজনক।