শ্রীলঙ্কায় চা চাষ: চা বিশ্বজুড়ে একটি বহুল জনপ্রিয় পানীয়, আর এর উৎপাদনে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। উত্তর গোলার্ধে রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে ককেসাস পর্বত থেকে শুরু করে দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার নাটাল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে চা চাষ হয়, তবে সর্বাধিক পরিমাণে এটি 32° উত্তর অক্ষাংশ থেকে 4° দক্ষিণ অক্ষাংশ এবং 30° পূর্ব দ্রাঘিমা থেকে 140° পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যে সীমাবদ্ধ এলাকায় উৎপন্ন হয়। এই ভৌগোলিক বেল্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো শ্রীলঙ্কা, যা চা উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে (চীন, ভারত ও কেনিয়ার পরে)।
FAO-এর তথ্যানুসারে 2012 খ্রিস্টাব্দে শ্রীলঙ্কায় চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩.২৮ লক্ষ টন, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় ৭.০১%। হেক্টর প্রতি প্রায় ১.৫ হাজার কেজি উৎপাদনশীলতা শ্রীলঙ্কাকে একটি প্রতিযোগিতামূলক চা উৎপাদক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
চা চাষের অনুকূল পরিবেশ
শ্রীলঙ্কা ভৌগোলিক গঠন, জলবায়ু এবং মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যের কারণে চা চাষে বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে। দ্বীপটির কেন্দ্রীয় উচ্চভূমি অঞ্চল, যেমন নুয়ারা এলিয়া ও ক্যান্ডি, ২,০০০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় বিস্তৃত, যেখানে ঠান্ডা ও আর্দ্র আবহাওয়া চা গাছের বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট সহায়ক।
চা গাছের জন্য গড় তাপমাত্রা ১৮° থেকে ৩০° সেলসিয়াস এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত প্রয়োজন হয়। শ্রীলঙ্কায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২০০০–৩০০০ মিলিমিটার, যা চা বাগানের সঠিক আর্দ্রতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
উর্বর দোআঁশ ও লালচে মাটি চা গাছের শিকড়কে প্রয়োজনীয় খনিজ সরবরাহ করে। নিম্নভূমি অঞ্চলগুলোতেও বৃষ্টিপাত ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু কালো চায়ের উৎপাদনকে উৎসাহিত করে। ফলে উচ্চভূমির হালকা সুগন্ধযুক্ত চা থেকে শুরু করে নিম্নভূমির ঘন ও শক্তিশালী চা—সবই শ্রীলঙ্কায় উৎপাদিত হয়।
আরও পড়ুন: চা চাষের অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশ
শ্রীলঙ্কার প্রধান চা উৎপাদক অঞ্চল
শ্রীলঙ্কায় চা উৎপাদনকে প্রধানত ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করা যায়, প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বাদ রয়েছে, যা “সিলন চা”-এর বৈশ্বিক বৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
গ্যল (Galle)
গ্যল শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলবর্তী একটি অঞ্চল, যা নিম্নভূমির চা উৎপাদনের জন্য পরিচিত। এখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০০ মিটার উচ্চতায় চা চাষ করা হয়। গ্যল অঞ্চলের জলবায়ু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আর্দ্র, যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও উষ্ণ আবহাওয়া চা গাছের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী। এখানকার চা সাধারণত গাঢ় রঙের ও শক্ত স্বাদের হয়, যা “কালো চা” হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে জনপ্রিয়। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে গ্যলের চায়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে, কারণ সেখানে ঘন, গাঢ় এবং দুধ-চায়ের জন্য উপযোগী জাতের চা বেশি পছন্দ করা হয়। এই অঞ্চলের চা আন্তর্জাতিক বাজারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় উৎস।
ক্যান্ডি (Kandy)
ক্যান্ডি অঞ্চলকে শ্রীলঙ্কার চা চাষের জন্মভূমি বলা হয়, কারণ এখানেই প্রথম ব্যাপকভাবে চা চাষ শুরু হয়েছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০০ থেকে ১২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই অঞ্চলটি মাঝারি উচ্চতার চা উৎপাদনের জন্য পরিচিত। এখানে জলবায়ু শীতল ও আর্দ্র হলেও বৃষ্টিপাত ঋতুভেদে ভিন্ন হয়। ক্যান্ডি অঞ্চলের চা রঙে গাঢ় এবং স্বাদে কিছুটা শক্তিশালী। যদিও হেক্টর প্রতি উৎপাদনশীলতা তুলনামূলকভাবে কম, তবে এখানকার চায়ের গুণগত মান আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বিশেষ করে ইউরোপ ও জাপানের বাজারে ক্যান্ডি চায়ের বিশেষ চাহিদা রয়েছে, কারণ এটি দুধ ও চিনি ছাড়া পান করলেও স্বাদে ভারসাম্য বজায় রাখে।
উডা (Uda Pussellawa বা Uda Region)
শ্রীলঙ্কার মধ্যভাগের পূর্ব পার্বত্য ঢালে অবস্থিত উডা অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০০–১৭০০ মিটার উচ্চতায় বিস্তৃত। এখানে তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা এবং বৃষ্টিপাত পর্যাপ্ত, যা সুগন্ধযুক্ত চা উৎপাদনের জন্য আদর্শ পরিবেশ প্রদান করে। উডা অঞ্চলের চায়ের স্বাদ হালকা, তবে সুগন্ধ অসাধারণ, যা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছে। বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোতে উডার চা এক ধরনের ‘লাইট টি’ হিসেবে প্রচলিত। এই অঞ্চলের চা সাধারণত বিকেলের চা (Afternoon Tea) হিসেবে ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি স্বাদে হালকা হলেও সতেজতা প্রদান করে।
নুয়ারা এলিয়া (Nuwara Eliya)
শ্রীলঙ্কার সর্বাধিক বিখ্যাত ও উচ্চতম চা উৎপাদন অঞ্চল হলো নুয়ারা এলিয়া। এখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০০ মিটার উচ্চতায় চা বাগান বিস্তৃত। ঠান্ডা জলবায়ু, কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ি পরিবেশ এবং আগ্নেয় মাটির উর্বরতা এই অঞ্চলের চা উৎপাদনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নুয়ারা এলিয়া অঞ্চলের চায়ের স্বাদ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও মৃদু, আর এর সুগন্ধ আলাদা রকমের সতেজতা বহন করে। আন্তর্জাতিক বাজারে এটিকে প্রায়শই “শ্রীলঙ্কার শ্যাম্পেন চা” (Champagne of Ceylon Tea) বলা হয়। ইউরোপ, জাপান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অভিজাত শ্রেণির বাজারে নুয়ারা এলিয়ার চা অত্যন্ত কদর পায়। এর রপ্তানি মূল্যও তুলনামূলকভাবে বেশি, কারণ এটি প্রিমিয়াম গ্রেডের চা হিসেবে স্বীকৃত।
ডিমবুলা (Dimbula)
ডিমবুলা অঞ্চল শ্রীলঙ্কার পশ্চিম পার্বত্য ঢালে অবস্থিত, যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১০০ থেকে ১৭০০ মিটার উচ্চতায় চা উৎপাদন করা হয়। প্রথমদিকে এখানে কফি চাষ হতো, তবে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পর কফি রোগে নষ্ট হলে চা চাষ শুরু হয়। ডিমবুলা অঞ্চলের চা ভারসাম্যপূর্ণ স্বাদ ও ঘ্রাণের জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাত। এটি neither খুব হালকা, nor খুব শক্তিশালী, বরং মাঝামাঝি মানের চা হিসেবে পরিচিত। ইউরোপীয় বাজারে এই অঞ্চলের চায়ের জনপ্রিয়তা বিশেষভাবে বেশি। শীতকালীন মৌসুমে উৎপাদিত ডিমবুলা চা বিশেষভাবে উৎকৃষ্ট মানের হিসেবে বিবেচিত হয় এবং উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়।
রুহুনা (Ruhuna)
রুহুনা অঞ্চল শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাংশে অবস্থিত, যেখানে চা বাগানসমূহ অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় (প্রায় ৬০০ মিটার) বিস্তৃত। এখানে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উষ্ণ জলবায়ু বিদ্যমান, এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত চা চাষকে সহায়তা করে। রুহুনার চায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এদের গাঢ় রঙ, শক্ত স্বাদ এবং বিশেষ ধরনের ঘ্রাণ। এই অঞ্চলে মূলত কালো চা (Black Tea) উৎপাদিত হয়, যা দুধ চা বানানোর জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয়। রাশিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে রুহুনার চায়ের চাহিদা সর্বাধিক। আন্তর্জাতিক বাজারে এটি শ্রীলঙ্কার রপ্তানিযোগ্য চায়ের একটি বড় অংশ গঠন করে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও রপ্তানি
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে চা শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেশের অন্যতম প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস। ২০১১ সালে FAO-এর তথ্যানুসারে, শ্রীলঙ্কা প্রায় ৩,২১,০৭৪ টন চা বিদেশে রপ্তানি করেছিল। চায়ের রপ্তানির দিক থেকে শ্রীলঙ্কা বিশ্বের দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। চা শিল্পে লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়, বিশেষত গ্রামীণ নারীরা শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ হিসেবে যুক্ত থাকেন। আন্তর্জাতিকভাবে “সিলন চা” গুণগত মান ও বিশুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত, যা ব্রিটেন, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে ব্যাপক চাহিদা অর্জন করেছে।
উপসংহার
সব মিলিয়ে বলা যায়, শ্রীলঙ্কার ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, উর্বর মাটি ও অনুকূল আবহাওয়া চা চাষকে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। নুয়ারা এলিয়ার সূক্ষ্ম সুগন্ধি চা থেকে রুহুনার ঘন কালো চা—প্রতিটি অঞ্চলের স্বকীয়তা আন্তর্জাতিক বাজারে শ্রীলঙ্কাকে একটি বিশেষ স্থান দিয়েছে। চা শুধু কৃষিজ পণ্য নয়, বরং শ্রীলঙ্কার জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক। ভবিষ্যতে আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা তার চা শিল্পকে আরও শক্তিশালী ও টেকসই করে তুলতে সক্ষম হবে।